শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
অ্যা হাংরি ম্যান ইজ অ্যান অ্যাংরি ম্যান
মোফাজ্জল করিম
প্রকাশ: শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭:৩০ PM
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ভয়েস অব আমেরিকা নাকি বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির ওপর জনমত জরিপ করে দেখেছে, দেশের ৪৭ দশমিক সাত শতাংশ মানুষ মনে করে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার খারাপ করছে। শুধু তা-ই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে এই সরকার ‘গত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ পারফরম করছে’। গণমাধ্যম ওই জরিপের প্রয়োজনীয় ফলাফল তাদের প্রতিবেদনে সন্নিবেশ করে প্রতিবেদনটিকে তথ্যনির্ভর করেছে। আর যেহেতু জরিপটি করেছে ভয়েস অব আমেরিকার মতো একটি দায়িত্বশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, অতএব এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর।

তা ছাড়া যার গায়ে ১০৪/৫ ডিগ্রি জ্বর, তাকে তার জ্বরের কথা থার্মোমিটার দিয়ে মেপে ‘আপনার জ্বর হয়েছে’ বলার প্রয়োজন পড়ে না। দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশের মানুষকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কথা বলার মানে হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা। তা-ও আবার গত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ‘খারাপ পারফরম করছে’ বলা। আওয়ামী আমলে মানুষ যে কোন বেহেশতে ছিল, তা ভয়েস অব আমেরিকার কাছ থেকে এ দেশের মানুষকে জানতে হবে না।

ইংরেজিতে ওই যে একটি প্রবাদবাক্য আছে না, ‘ওয়েরার নোজ বেস্ট হোয়্যার দ্য শু পিনচেস’্যÑ জুতা যিনি পরেছেন, তিনিই ভালো জানেন জুতার ভেতরের তারকাঁটা কোথায় তাকে খোঁচাচ্ছে। আর ওই আওয়ামী জুতা তো আর এক দিন দুই দিন বা এক মাস দুই মাস নয়, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জুতার ব্যবহারকারীর জান বের করে ছেড়েছে। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের অন্তরে স্থান লাভ করেছে, না মানুষ এখনো ‘পলাতকা আওয়ামী নেত্রীর’ হেলিকপ্টার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে, সে হিসাব-কিতাব বাদ দিয়ে আসুন আমরা বরং বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারটা বিবেচনা করি। যিনি জাতিকে, বিশেষ করে তার অগণিত সহকর্মী ও অনুগামীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শোক সাগরে ভাসিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গিয়ে পেয়ারে দাদাবাবুর ওখানে সভগিনী চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-র সেবা করছেন এবং দিনরাত ‘দু’আ ইউনূস’ জপছেন, তিনি আবার কবে দেশে ফিরবেন, নাকি চিরতরে বাই-বাই টা-টা জানিয়ে চলে গেছেন সেই গবেষণায় দেশের মানুষের পেট ভরবে না।

তারা এখন কোনোমতে এবেলা দু’মুঠো অন্ন সংস্থান করতে পারলেও রাত পোহালে ছানাপোনার মুখে কী তুলে দেবে সেই চিন্তায় পাগল হওয়ার জোগাড়।

শহরের বস্তিবাসীরা নানা ফন্দি-ফিকির করে একবেলা খেয়ে, দু’বেলা না খেয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটিয়ে দেয়। খেটে খাওয়া দিনমজুররা তাদের মজুরি বাড়িয়ে দিয়ে, না হয় ধারদেনা করে কোনো না কোনোভাবে ডুবুডুবু সংসার-তরণী ভাসিয়ে রাখছে। পরিবারের পুরুষটি রিকশা চালালে বা ঠেলাগাড়ি ঠেললে মহিলাটিকে দেখা যায় সাহেবসুবোদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসারে আয় বাড়াতে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই রোজগারের ধান্দায় সারা দিন ঘরের বাইরে থাকায় শিশু-সন্তানদের দেখাশোনা করার কেউ থাকে না।

বস্তিবাসীদের জীবনে তাই প্রতিবেশীদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা একে অন্যের শুধু বিপদে-আপদে, ঠেকা-অঠেকায়ই নয়, দৈনন্দিন জীবনে অনেকটা একই পরিবারের সদস্যের মতো ভূমিকা পালন করেন। এভাবেই এগিয়ে চলে তাদের ছন্দহীন জীবনের কাব্য। এককথায়, খেয়ে না খেয়ে, দুঃখে-কষ্টে দিন কাটে শহরের বস্তিবাসীদের জীবন। কিন্তু এখন নাকি সেই জীবনও আর চলছে না। এমনটিই বললেন আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত পঞ্চাশোর্ধ্ব এক রিকশাওয়ালা। জীবনের প্রতি ইদানীং নাকি তার বিতৃষ্ণা এসে গেছে। কেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আজ তিরিশ বছর ধইরা এই শহরে রিকশা চালাইয়া কোনোমতে বৌ-বাচ্চা লইয়া বাঁইচ্যা আছি। বৌ দুইটা বাসায় বুয়ার কাজ কইরা মাসে ১০/১২ হাজার টাকা পায়। তিনটা বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া মোটামুটি ভালোই চলতাছিল আমাদের সংসার। কিন্তু স্যার, এখন তো আর পারতাছি না। চাউল-ডাউল, তেল, তরিতরকারি সব কিছুর দাম এমুন বাড়া বাড়ছে, মনে হয় হাত দিয়া ছুঁইলে হাত পুইড়া যাইব। আলুর কেজি সোয়া শ টাকা—এইডা কোনো কতা অইল?’ ... বলতে বলতে তার বুক ফেটে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হলো, আর চোখ দুটি দিয়ে যেন আগুন।

আমার এই পুরনো সুহৃদ সলিমদ্দি রিকশাওয়ালার মতো ঢাকা শহরে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ কম করে হলেও ৭০-৮০ লাখ তো হবেই। এদের প্রায় সবারই শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। সেখানে খেয়ে না খেয়ে দিন গুজরান হচ্ছিল তাদের। এদের বাপ-দাদারা ছিল ক্ষুদ্র চাষি, আর না হয় ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। দুঃখ-কষ্টের জীবনে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে একদিন নদীভাঙনে তারা হারাল তাদের বসতবাড়ি। তার পর থেকে শুরু হয় ঢাকা শহরে তাদের বস্তিজীবন।

আর তারা যাদের ফেলে আসে নিভৃত পল্লীর অনিশ্চিত জীবনে, তারা কেমন আছে? ঠিক তাদের খোঁজ নিতে নয়Ñ ওটা বললে সত্যের অপলাপ হবে- আমার আজীবনের অভ্যাসমতো আমি মাসে-দু’মাসে একবার গ্রামে যাই আমার নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে। সারা জীবন তারা আমার আত্মার আত্মীয়, আমার মঙ্গলাকাক্সক্ষী। আর গ্রামে যাওয়া মানেই এদের আদরে-সোহাগে আপ্লুত হয়ে আমার পছন্দের শাক-শুঁটকি দিয়ে ভূরিভোজন।

এবার গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসী প্রায় সবার মুখ দেখলাম শুকনা। কোনো আনন্দের চিহ্নমাত্র নেই তাদের চেহারা-সুরতে। কী ব্যাপার? কুশলাদি জানতে চাইলে তারা সবাই প্রায় একবাক্যে জানালেন, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। তারা নাকি তাদের ‘বাপজন্মে’ কোনো দিন মাছ-মাংস, শাক-সবজি, চাল-ডাল-তেল-পেঁয়াজ-রসুন ইত্যাদির দামের এমন বেয়াড়া রকম উল্লম্ফন দেখেননি। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো নাকি এবার আরেকটি উপদ্রব দেখা দিয়েছে। চুরি-চামারি। গ্রাম সম্পর্কের এক চাচা তো তার গরু চুরির কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। বেচারা গরিব মানুষ। ধার-কর্জ করে দুটি এঁড়ে বাছুর কিনে পেলে-পুষে, খাইয়ে-দাইয়ে মোটাতাজা করছিলেন সামনের কোরবানি ঈদে ভালো দামে বিক্রি করার জন্য। বেচারার এমনই কপাল, চোর গোয়ালঘরের নড়বড়ে দরজা ভেঙে গরু দুটি নিয়ে রাতের আঁধারে দে চম্পট। হাজিরানে মজলিসের আরেকজন বললেন, হাটফেরা পথে তিনি নাকি চ্যাংড়া বয়সের কজন ছিনতাইকারীর হাতে টাকা-পয়সা সব খুইয়েছেন কদিন আগে। ... হাতে সময় ছিল না, তাই এসব চুরি-চামারির কথা আর শোনা হয়নি। তবে যা বুঝলাম আলাপ-আলোচনায়, তাতে এটি পরিষ্কার হলো, গ্রামের মানুষের পেটে দানাপানি খুব একটা পড়ে না আজকাল। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো না। সরকার পরিবর্তনে মানুষ যে আশার আলো দেখতে পেয়েছিল মাস চারেক আগে, সেই আলো এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে আসছে। আর বিগত দিনে যারা সেই আমলের সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিল নানাভাবে, তারা এরই মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কূটনামি শুরু করে দিয়েছে। এদের মুখ বন্ধ করতে হলে সর্বাগ্রে যা করতে হবে, তা হচ্ছে দেশের অগণিত দরিদ্র শ্রেণির মানুষের পেটে ভাত আর চোখে ঘুমের ব্যবস্থা করা। এটি ঠিক, বর্তমান সরকার দেশের লেজে-গোবরে পড়া অর্থনীতিকে জোড়াতালি দিয়ে মোটামুটি একটি ভদ্রসম্মত অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছে। যথাসময়ে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কলুষমুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থাও করছে। কিন্তু সব কথার শেষ কথা হচ্ছে পেট পুরে দুটি খেতে পারা এবং নিঃশঙ্কচিত্তে শান্তিতে ছানাপোনা নিয়ে দিন গুজরান।

সবিনয়ে সেই ইংরেজি পুরনো প্রবচনটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই লেখাটি শেষ করার আগেÑ অ্যা হাংরি ম্যান ইজ অ্যান অ্যাংরি ম্যান। পেটের ক্ষুধা আর মনের অশান্তি দুটিই কিন্তু বড় ভয়ানক জিনিস। অতএব দ্রব্যমূল্য এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমার মতে এখন প্রায়োরিটি নম্বর ওয়ান হতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
যে খাবার শরীরের ক্ষতি ডেকে আনে
শীত আরও বাড়বে বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর
ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা পাবেন সম্মানী ভাতা, কে কত?
বই থেকে 'আদিবাসী' গ্রাফিতি বাদ দেওয়ায় টিআইবির উদ্বেগ
পঞ্চগড়ে শৈত্যপ্রবাহ কাটলেও কমছে না শীতের দাপট
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
অপহরণ বাণিজ্য বন্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান চান টেকনাফের মানুষ
মাহফিলে সুদের বিরুদ্ধে কথা বললেন হাসনাত আবদুল্লাহ
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়মী লীগের জয়জয়কার
গাজীপুরে শ্রমিক নেতা আব্দুল হামিদের দাফন সম্পন্ন
জাবি ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদ-কৌশিকসহ ছয় নেতা বহিষ্কার
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft