শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৫
লকডাউন, অনৈক্য এবং নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
রুহুল রায়হান
প্রকাশ: বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:০০ পিএম
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়েছে। সবুজ-শ্যামলিমা বদ্বীপ বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্ব মানচিত্রে বুক চিতিয়ে আছে দেশ। ক্ষুধা-দারিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ আর নেই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডটি। তারপরও কথা থাকে। এখনো আমাদের মাঝে কেন হানাহানি? 

কথার ছলে অতীতে ফিরতে হয়। পাকিস্তানী শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। একটি স্বাধীন দেশ পেলাম আমরা অনেক রক্ত আর ত্যাগ তিতীক্ষার ফলে। কিন্তু আমরা পেলাম না একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো। একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক ভিত। এর জন্য কি রাজনীতি-রাজনৈতিক নেতারা দায়ী নন। 

এ দেশের সাধারণ মানুষ সরল-সহজ। বিশ্বের নানা প্রান্তে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দেশের কামার, কুমার, জেলে, মজুর, কৃষক ও এমনতর আরো পেশার লোকেরা সহজিয়া। তারা শ্রমের ঘানি টানে। দিন এনে দিন খেয়ে খুশি। কোনো কূটচাল বুঝে না তারা। 

পোশাক শ্রমিকটি বুঝে গায়ে-গতরে খেটে একটু বেশি আয় করা যায় কীভাবে। প্রবাসে থেকেও প্রাণের শিহরণে আপনজনদের খোঁজ করে একাকী থাকা ভাইটি। কিন্তু কী যেন কী নেই। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় প্রিয় বাংলাদেশ ভালো নেই। এ দেশের রাজনীতিবিদদের মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি গভীর প্রেম নেই। তারা দেশকে পেছনে ঠেলে ধরে। গরীবের মাথায় ঋণের বোঝা চাপায়। মজদুরের রক্তে ক্ষমতার প্রাসাদ গড়ে। অথচ কথা ছিল ভিন্ন। দেশ হবে সত্যিকার গণতান্ত্রিক। মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হবে। জনসাধারণের ইচ্ছায় ক্ষমতার পালাবদল হবে। কিন্তু কী হচ্ছে চারপাশে?

বিগত অনেকটা সময় দেশের মানুষ নানা শাসন দেখেছে। তাদের ভাগ্য বদল হয়নি। অথচ তাদের চেষ্টায় কমতি নেই। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তারা শ্রমের মর্যাদা পায় না। ক্ষমতার পালাবদল ঠিকই হয়। ভাগ্যের বদল হয় শাসক-লুটেরাদের। নানা সময়ে তারা মানুষের জীবনমান পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সর্বশেষ ১৫ বছর গণতন্ত্র আরো বেশি মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের ভোট উৎসব ফিকে হয়েছে। নির্বাচন বলে বিষয়টি শুধুই পুস্তকে আশ্রয় নিয়েছে। এর মাঝে চাপা কষ্ট আর ক্রোধ জমে বিস্ফোরিত হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনের যবনিকা হয়েছে। দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সংগ্রামে ছিলেন। ছিলেন ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক সব দলের নেতা-কর্মী। অদ্ভুত ও অভাবনীয় মিলন হয়েছিল সবার। 

কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার টানাপোড়নে সব কেমন যেন হয়ে গেল। বিভেদ আবার ভর করলো রাজনীতিতে। এর মাঝে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সব প্রস্তুতি সেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারকে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত। কিন্তু রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা বুঝি তা চান না। তারা কী চায় এখন জনগণের বোধগম্য নয়। তারা পারস্পরিক ভেদাভেদ বাড়াতে ব্যস্ত। একটি সরল সমীকরণে তারা আসতে চান না। ফলে দেশকে উদ্দীষ্ট লক্ষে নিয়ে যাওয়ার একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। একটি চিরায়ত আনন্দের ভোট উৎসব হওয়ার পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। 

এই সুযোগে স্বৈরাচারী সরকার নতুন স্বপ্ন বুনছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে তারা। গত কিছুদিন দেশ নাশকতার পরিপূর্ণ। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও প্রাণ ঝরছে। আগুনে পুড়ছে দেশের সম্পদ, মানুষের বেঁচে থাকার মন্ত্র। এ বুঝি আশার ছলনা। একটি সঠিক নির্বাচন হবে। দেশ পাবে নির্বাচিত সরকার। আবার পতপত করে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু তা হতে দেওয়া যাবে নাÑ ভাবনায় মত্ত হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেশ-বিদেশের নানা গোষ্ঠী। 
কিন্তু আমরা সজ্ঞানে তা হতে দিচ্ছি। নিজেদের মধ্যে বৈষম্য গড়ছি। মজার ও কষ্টের বিষয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছি আমরা। আমাদের চরিত্রের বদল হয়েছে কি? দেশে বৈষম্য রুখতে পেরেছে কি আমরা?

এখন কীভাবে সম্ভব একটি সঠিক ও ফলপ্রসু নির্বাচন। এই নির্বাচনের বড় নিয়ন্তা রাজনীতিবিদরা। তারাই জয়ী হয়ে দেশ গড়বে। কিন্তু তারা রাজনীতিবিদই রয়ে যান। দেশপ্রেমিক হন না কখনো। 
তারা অবশ্য এ কথা মানতে নারাজ। তারা দাবি করেন সব সময়Ñ তাদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক নেই! কিন্তু যে ভাইটি মরুর তপ্ততায়, গনগনে রোদ্দুরে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠান তার চাওয়া রক্ষা হয় না। যে বোনটি নাগরিক জীবনে এক মুঠো খাবারের সংস্থান করতে ছুটে চলেন সেলাইদিদি হয়ে তার ইচ্ছা পূরণ হয় না। তারাই কিন্তু বড় দেশপ্রেমিক। কিন্তু সবকিছু নষ্টদের অধিকারে। উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ। 

প্রতিদিন অজানা ভয় নিয়ে নাগরিক ছলাকলা। আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেকে মেলে ধরা। ঝলসে যায় স্বপ্ন, ঝলসে যায় প্রিয় বাংলাভূমি। এদিকে রাজনীতির মারপ্যাচ শেষ হয় না। 
প্রতিদিন আমরা খবর দেখি। অজানা ভয় জেগে উঠে আমাদের মাঝে। দেশ ক্ষণে ক্ষণে অনিশ্চয়তায় দোলাচলে পড়ে। 

আবারো বলি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন ক্রমেই উত্তপ্ত ও অস্থির হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগের ঘোষিত লকডাউন, সারা দেশে নাশকতার ঘটনা, বাস পোড়ানো ও ককটেল বিস্ফোরণের মতো সহিংস কার্যক্রমÑ সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত। এমন অবস্থায় নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ বাড়ছে সর্বত্র।

সরকার বারবার ঘোষণা দিয়েছে যে নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘জুলাই সনদ’-এর বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের সঙ্গে তীব্র বিরোধে জড়িয়েছে। তারা দাবি করছে, এই সনদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অন্যথায় তারা ভোটে অংশ নেবে না। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের। তারা আবারো অতীতের মতো ভয়, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিগত সময়ে নির্বাচনকে ঘিরে যে ধরনের সহিংসতা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, এবারো সেই আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। দেশের অর্থনীতি এখনো করোনা ও গণ-অভুত্থানপরবর্তী ক্ষতির চাপ থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, এর ওপর রাজনৈতিক সহিংসতা ও লকডাউন ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেÑ এ নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও সতর্ক করছেন।

এমন ক্ষণে সমাধান একটি। সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে ছাড়ের মানসিকতা নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ছাড় দেওয়ার মনোভাব নেইই। সব পক্ষই এখন পরস্পরকে প্রতিপক্ষ নয়, শত্রু হিসেবে দেখছে। পরস্পরের ওপর আস্থাহীনতা এতটাই বেড়েছে যে, যেকোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ এখন সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অথচ, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে সংলাপ, সমঝোতা ও আস্থার পরিবেশই সবচেয়ে জরুরি।

নির্বাচন কোনো দল বা সরকারের একার বিষয় নয়; এটি গোটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনই দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য অপরিহার্য। যদি দলগুলো নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তবে দেশ আবারো এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়বেÑ যার মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তাই, এখনই সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার। সহিংসতার পথে না গিয়ে আলোচনার টেবিলে ফেরা উচিত। 

বাংলাদেশের মানুষ শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন চায়। রাজনীতি যদি সেই প্রত্যাশার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে এর দায় নিতে হবে রাজনীতিকদেরই। এখন প্রয়োজন সহিংসতার রাজনীতি নয়, আস্থার রাজনীতিÑ যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, কিন্তু শত্রুতা নয়; মতভেদ থাকবে, কিন্তু দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে নয়। সময় এসেছে সেই প্রজ্ঞার, যা কেবলই আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হতে পারে।

পরিশেষে বলি, দাম দিয়ে কেনা বাংলাকে বেপথে ঠেলে দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রকে বোতলবন্দী করে রাখা যাবে না। বাংলার মাটি বাংলার জল অনেক দেনা শোধ করেছে অনেকটা সময়। আর নয় প্রবঞ্চনা। আর নয় দীর্ঘশ্বাস। চাই একটি চিরায়ত কাঠামো, গণতান্ত্রিক পরিবেশ। চাই জবাবদিহি, অন্যায় ও ন্যায়ের, বোধ ও বিভেদের। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বোধের সংসারে আমন্ত্রণ। তোমাদের অভিবাধন, বোমা নয় গোলাপের কুচকাওয়াজ হোক। একটি যুগান্তকারী নির্বাচন হোক। মুছে যাক সব ভয়। আবার যেন সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির সূর্য উঠে বাংলার প্রতিটি ঘরে। 

রুহুল রায়হান: কবি ও সাংবাদিক।

আজকালের খবর/ এমকে








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
ড্রামে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা, আসামি নিহতের বন্ধু
একটি দল ‘জান্নাতের টিকিট বিক্রি’ করে ভোটের বৈতরণী পার হতে চায়: সালাহউদ্দিন
কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না
এবার পটুয়াখালীতেও জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
আগামীকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন
আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচিতে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি
শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার প্রত্যাশা চিফ প্রসিকিউটরের
লকডাউন, অনৈক্য এবং নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft