
দেশের মানুষকে স্বস্থি দিতে হলে এ মুহুর্তে জরুরি হচ্ছে দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ,বিনিয়োগ,কর্মসংস্থান বৃদ্ধি,বন্ধ কলকারখানাসহ রপ্তানী মুখী তৈরী পোশাক শিল্পের অস্থিরতা নিরসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। সর্বোপরি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা নিরসনে আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে জনপ্রত্যাশিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
অবশ্য দেশের দুর্বল অর্থনীতির জন্য ‘বিষফোঁড়’ হিসেবে বিদেশে অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটকে দায়ি করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষমহল। একই ভাবে রাজনৈতিক দলসমূহ,সরকারি মহল অর্থনীতির বিশ্লেষক,ব্যবসায়ি নেতৃবৃন্দ অনুরুপ মন্তব্য করে দুর্বল অর্থনীতিকে সবল ও গতিশীল করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। সম্ভাব্য এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের জন্য যতটা কঠিক তার চেয়ে আরো কঠিন হবে পরবর্তী সরকারের জন্য। তাই নতুন বছরে নতুন নির্বাচিত সরকারের যাত্রা শুরু হবে দুর্বল অর্থনীতির চাকা সচল করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
প্রসঙ্গত: রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা, বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরনো সংকটগুলো নতুন বছরেও অর্থনীতিকে ভোগাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর সরকারের নীতিগত পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা।
কয়েক বছর ধরে চলমান অর্থনৈতিক চাপ এবং গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতি এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর এ কারণেই ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হয়েছে সংকোচনমূলক। এ কারণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছর সরকারকে অর্থনীতির ৭টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতির সময় অর্থ মন্ত্রণালয় ৭টি প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতির এই প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা নতুন সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারকে নতুন বছওে অর্থনীতিতে ১২টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
সেগুলো হলো- ১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ২. রাজস্ব আদায়, ৩. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ, ৪. বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, ৫. খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৬. দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, ৭. আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৮. শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, ৯. ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং সরকারি কর্মচারী তথা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, ১১. পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কৌশল এবং ১২. এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি।
অবশ্য অর্থনীতির বিশ্লেষকদেও মতে, বিনিয়োগ স্থবির, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বৈদেশিক বাণিজ্যে টানাপোড়েন, খেলাপি ঋণে ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এটি মোকাবিলায় সমন্বিত নীতি গ্রহণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর এবারের বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অতীতের রাজনৈতিক সরকারের মতোই ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি উৎস থেকে এবং বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার নজির এই সরকারের। তবে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকারের স্বাভাবিক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং বাজেট বাস্তবায়নে সুশৃঙ্খল প্রশাসন জরুরি। অথচ বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়সহ সারা দেশে সরকারি কর্মচারীর.শিক্ষক,কর্মচারি,ইঞ্জিনিয়ার,আনসার,গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী,চিকিৎসক,নার্সসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান,সংগঠন আন্দোলনে রাজপথে অবস্থান নিয়েছিল।
এমনি অবস্থায় তাদেও দাবি পূরণ এবং তাদেও কাএ জর ফেরনানো সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ ছিল। এর সঙ্গে চলতি ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। এমনি অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ০যা এখনো বলবৎ রয়েছে।
অন্যদিকে, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি অনুকূল ব্যবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে স্থিতিশীলতা আনা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি মৌলিক প্রয়োজন।
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় এটি একটি ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী শক্তিশালী করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক চাপ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
কর কাঠামো সংস্কার, কর ফাঁকি রোধ এবং রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়া চলমান। এই উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল গ্রহণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। দেশের শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করে শিল্প খাতকে আরও শক্তিশালী করা এই চ্যালেঞ্জের অংশ।
দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার আসন্ন নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমদানির সাম্প্রতিক বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে, অর্থনীতি আবার গতি ফিরে পেতে শুরু করেছে। মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও, মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশের উপরে রয়েছে। এটি নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো পণ্যমূল্য যে হারে বেড়েছে, তার তুলনায় অনেক কম হারে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবশ্য দেশের বিনিয়োগ সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল এবং রাতারাতি পুনরুজ্জীবিত করা যায় না। বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করার জন্য মুদ্রানীতি মাঝারিভাবে শিথিল করা উচিত। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য।
আমাদেও মনে রাখা উচিত,অর্থনৈতিক অভিজাতরা স্থায়ীভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত হন না। তবুও তারা রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশ করতে অসাধারণভাবে দক্ষ। তারা ধীরে ধীরে নীতি ও ক্ষমতার বলয় দখল করতে পারেন। তাদের প্রভাব যত বেশি হবে, অর্থনীতি ও সমাজে তারা তত গভীর বিকৃতি এবং অস্থিরতা প্রবেশ করাবে। যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে তারা যাদের কাছ থেকে সুবিধা নেয় তাদেরই ধ্বংস করে দেয়। উপমহাদেশে, ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী সমস্ত দলের সঙ্গে এটি ইতোমধ্যেই ঘটেছে।
যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয় তাদের সঙ্গে এটি আবারো ঘটতে পারে। যেসব রাজনৈতিক দল সুশাসন এবং সমাজকল্যাণে স্থাপিত একটি নতুন ধরনের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী, তাদের অবশ্যই আর্থিক খাতকে তাদের দুষ্টু প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে।
এই কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কারণ আমরা ভবিষ্যতে যেকোনো লুণ্ঠন থেকে আমাদের আর্থিক সম্পদ রক্ষা করতে চাই। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা যার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরবর্তী নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার এটি নির্ধারণ করবে যে, আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রক্রিয়াা অদূরভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে কিনা। অন্যদিকে, দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে, কেবল প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়।
এজন্য প্রয়োজন দারিদ্র বিমোচনে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি,সম্পদের সুষম বন্ঠন,সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো,দুর্নীতি,অপচয়,অর্থপাচারের লাগাম টানা অপরিহার্য্য।
মোতাহার হোসেন: সম্পাদক-ক্লাইমেট জার্নাল২৪.কম এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ) নভেম্ববর ০৮,২০২৫ ইং।
আজকালের খবর/ এমকে