পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বৈশ্বিক শক্তির টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশ এমন এক সংকটে পড়েছে, যেখানে ব্যালান্স রক্ষা না করা গেলে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও কূটনীতির ক্ষেত্রে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী করতে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক সংলাপে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন বক্তারা।
সাবেক পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়তে হবে, তবে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কী ধরনের প্রকল্পে অর্থ যাবে, তা নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের (ডায়াস্পোরা) সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
সিজিএসের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এখন চায়, আপনি হয় তাদের সঙ্গে থাকবেন, নয়তো চীনের সঙ্গে। এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। বেকারত্ব বেড়েছে, মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক, আর এসব কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতার মধ্যে বাংলাদেশ এখন বাজেভাবে আটকে গেছে। আমরা চীন থেকে কাঁচামাল কিনি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বসিয়ে দেয়। আবার রপ্তানি বাজার হিসেবে সবচেয়ে বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্র। তাই যক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ইউরোপের দিকে ঝুঁকতে চাওয়া বোকামি।’
ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘আগের সরকার দাসত্বমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতো। এখন ভারসাম্যহীন কূটনীতি চলছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা স্পষ্ট নয়। নদীর পানিবণ্টনসহ বড় ইস্যুতে ভাবনার ঘাটতি আছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘আমরা আমদানিনির্ভর অর্থনীতির মধ্যে আছি। রেমিট্যান্স আর গার্মেন্টস আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। রপ্তানির বড় অংশ যায় আমেরিকা ও ইউরোপে। এ অবস্থায় কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই। ভারতের ওপর নির্ভর করে থেকেছি, কিন্তু বিকল্প ভাবিনি। এখন রোহিঙ্গা সমস্যা বা পানি ইস্যুতে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না।’
সাবেক কূটনীতিক এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক অবস্থান বদলে গেলে সমস্যায় পড়েন পেশাদার কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটি ন্যাশনাল কনসেনসাস জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি এবং তা জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এলডিসি উত্তরণ খারাপ কিছু নয়, তবে এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি থাকা দরকার। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’—এই নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সিনিয়র গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির বলেন, ‘গত ১৬ বছরে পররাষ্ট্রনীতি বলে কিছু ছিল কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে গতিশীল না করলে কূটনীতি কার্যকর হবে না।’
ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ‘ফ্রেন্ডশিপ টু অল’ বললেও বাস্তবে এখন ‘ফ্রেন্ডশিপ টু ওয়ান’ হয়ে গেছে। ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসি ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।’
সেন্টার ফর নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিজ'র চেয়ারম্যান এম এস এম এস সেকিল চৌধুরী ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি দুইজনই বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি শুধু কূটনীতিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যবসায়ী, প্রযুক্তিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দরকার দক্ষ নেগোসিয়েটর এবং স্বচ্ছ কাঠামো।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি শক্ত না হলে পররাষ্ট্রনীতি দাঁড়াবে না। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা ছোট পরিসরে হলেও দেখা দিতে পারে।’
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ রিপোর্ট বলছে, রোহিঙ্গা সংকটে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।’
আজকালের খবর/ এমকে