প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫, ২:১৩ পিএম

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবাদিপশুর মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ বা সংক্ষেপে লাম্পি রোগ। কৃষক ও খামারিদের কাছে আতঙ্কের নাম এটি। মূলত গরুকে আক্রান্ত করা ভাইরাসঘটিত রোগটি খুব সহজেই এক পশু থেকে আরেক পশুতে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সামান্য জ্বর ও ত্বকে গুটির মতো দেখা দিলেও অবহেলার কারণে পশুর মৃত্যু ঘটে। এ রোগ সম্পর্কে এখনো অনেক খামারি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে বিভ্রান্তি, ভুল ধারণা এবং সচেতনতাহীনতা। ফলে দেশজুড়ে বাড়ছে মৃত্যুর হার।
লাম্পি রোগের লক্ষণ, বিস্তার, প্রতিরোধ এবং করণীয় সম্পর্কে যা বলছেন ইন্টার্ন প্রাণী চিকিৎসক মো. রাজিবুল ইসলাম।
লাম্পি স্কিন ডিজিজ কী?
‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ বা এলএসডি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা গবাদিপশুকে আক্রান্ত করে। রোগটি ক্যাপ্রিপক্সভাইরাস নামক একটি ডিএনএ ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ভাইরাসটি পক্সভাইরাস পক্সভিরিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এটি মূলত গরুতে বেশি দেখা গেলেও মহিষেও ছড়াতে পারে। এক গরু থেকে অন্য গরুতে এটি ছড়ায়। তবে ছাগল ও ভেড়ার শরীরে ভাইরাসটি প্রতিলিপি তৈরি করলেও সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত হয় না।
কোন সময় বেশি দেখা যায়
১. গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকালে এ রোগের প্রকোপ বেশি।
২. গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় যখন মশা, মাছি ইত্যাদি বাহক সক্রিয় থাকে; তখন এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।
৩. বন্যা ও জলাবদ্ধতা পূর্ণ এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।
লক্ষণসমূহ
>> জ্বর ১০৪°-১০৫° ফারেনহাইট।
>> গুটির মতো ফোস্কা সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। গুটি থেকে কখনো পুঁজ বের হয়।
>> খাওয়ার রুচি কমে যায় এবং গাভির দুধের পরিমাণ কমে যায়।
>> চোখ ও নাক দিয়ে পানি পড়া।
>> পা ফুলে যাওয়া ও খুঁড়িয়ে চলা।
কীভাবে ছড়ায়
১. মশা, মাছি প্রভৃতি বাহকের মাধ্যমে।
২. আক্রান্ত গরুর চোখ, নাক বা মুখ থেকে নিঃসৃত তরল দ্বারা।
৩. সুস্থ ও আক্রান্ত গরুকে একসঙ্গে রাখলে।
৪. একই সিরিঞ্জ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
• টিকা (এলএসডি ভ্যাকসিন) প্রয়োগ করা সবচেয়ে কার্যকর।
• আক্রান্ত গরুকে অবিলম্বে আলাদা করে কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা।
• অবশ্যই মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে অন্য গরু সংক্রমণ হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
• নিম পাতার রসের সঙ্গে চিটাগুড় মিশিয়ে প্রতিদিন ৫০০ মিলিলিটার এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।
• শরীরের ক্ষতস্থান টিংচার আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার রাখা।
• খামার বা আক্রান্ত পশুর আশপাশে মশা-মাছি ও কীটপতঙ্গ দমন।
• আক্রান্ত গাভির দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া উচিত।
• গোয়ালঘর সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
• আক্রান্ত গরুর দেখভালকারী যেন সুস্থ গরুর সংস্পর্শে না আসেন।
• সব সুস্থ গরুকে দ্রুত টিকা দেওয়া।যেসব ভুলে বাড়তে পারে
> আক্রান্ত গরুকে আলাদা না রাখা।
> সময়মতো টিকা না দেওয়া।
> অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার।
> ক্ষতস্থানে নোংরা বা অনুপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ।
> হাট থেকে গরু কিনে এনে সঙ্গে সঙ্গে অন্য গরুর সঙ্গে মেশানো।
> হাতুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতা
ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্পেইনে গিয়ে এ রোগের মহামারি রূপ দেখেছি। এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রায় ৯০ শতাংশ কারণ খামারি ও সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং হাতুড়ে চিকিৎসকের অপচিকিৎসা। কোনো কিছু হলেই গ্রামের সাধারণ মানুষ হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান। যেখানে তারা অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিহিস্টামিন ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন, যা একটি ভাইরাসজনিত রোগে কার্যকর নয়।
লাম্পি স্কিন রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা রেজিস্টার্ড প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া হাতুড়ে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষক ও খামারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব।
আজকালের খবর/ এমকে