
বিদেশে উচ্চশিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা বা পারিবারিক যে কোনো কাজের জন্য আপনার দেশের নথিপত্র (ডকুমেন্টস) যেন স্বীকৃত হয়, তজ্জন্যে মাথায় ‘সত্যায়ন, লিগালাইজেশন, নোটারি’ ইত্যাদি ধারণা বা পদ্ধতিগুলো ঘুরপাক খায়। সাধারণত নথিপত্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে করা লাগে অ্যাপোস্টিল। এটি আপনার নথির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে, যাতে সংশ্লিষ্ট বিদেশি কর্তৃপক্ষ আপনার ডকুমেন্ট যাচাই করে বৈধ বলে মেনে নেয়।
অ্যাপোস্টিল কী?
অ্যাপোস্টিল হলো একটি আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া, যা নথিপত্রের বৈধতা যাচাই করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ১৯৬১ সালের হেগ কনভেনশনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি পদ্ধতি, যার পূর্ণ নাম হলো “হেগ কনভেনশন অ্যাবোলিশিং দ্য রিকোয়ারমেন্ট অফ লিগালাইজেশন ফর ফরেন পাবলিক ডকুমেন্টস”। সংক্ষেপে ‘হেগ কনভেনশন’ বলে পরিচিত। এর মাধ্যমে একটি দেশে ইস্যুকৃত নথি অন্য একটি সদস্য দেশে বৈধভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। এটি একটি বিশেষ স্ট্যাম্প বা সিল, যা নথির উপর প্রয়োগ করা হয় এবং এটি নিশ্চিত করে যে নথিটি সত্য এবং বৈধ।
এই প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের নথিপত্র বিদেশে ব্যবহার করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন বাংলাদেশী নাগরিক যদি বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি, বা অভিবাসনের জন্য তাদের শিক্ষাগত সনদ, জন্ম সনদ, বা বিবাহ সনদ ব্যবহার করতে চান, তবে সেই নথি অ্যাপোস্টিল করা প্রয়োজন হতে পারে।
হেগ কনভেনশন:
হেগ কনভেনশন ১৯৬১ সালে গৃহীত হয়েছিল, এবং এটি বিশ্বব্যাপী নথির বৈধতা সহজতর করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই কনভেনশনের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নথি বিনিময়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লিগালাইজেশনের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করা হয়। বর্তমানে, ১২০ টিরও বেশি দেশ এই কনভেনশনের সদস্য। বাংলাদেশ ২০২২ সালে এই কনভেনশনের সদস্য হয়, যা বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক নথি বিনিময়কে আরও সহজ করে তুলেছে।
অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেটে যে তথ্যগুলো থাকে:
১) নথি ইস্যুকারী দেশের নাম
২) নথির স্বাক্ষরকারীর নাম
৩) স্বাক্ষরকারীর পদবি
৪) ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের নাম
৫) সার্টিফিকেশনের তারিখ ও স্থান
৬) অ্যাপোস্টিল নম্বর
৭) ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের সিল ও স্বাক্ষর
এই তথ্যগুলো নিশ্চিত করে যে নথিটি বিশ্বের অন্যান্য সদস্য দেশে গ্রহণযোগ্য হবে। বাংলাদেশে অ্যাপোস্টিল প্রক্রিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
যে প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে করবেন:
১. নথির প্রস্তুতি: অ্যাপোস্টিলের জন্য নথিটি প্রথমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা সত্যায়িত হতে হবে। যেমন- শিক্ষাগত সনদের ক্ষেত্রে— এসএসসি, এইচএসসি, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের ক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়, বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সত্যায়ন প্রয়োজন। জন্ম বা বিবাহ সনদের ক্ষেত্রে— স্থানীয় সরকারি অফিস, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, বা সিটি কর্পোরেশন থেকে সত্যায়িত হতে হবে। আইনি নথির ক্ষেত্রে— আদালত বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে সত্যায়ন প্রয়োজন।
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা: সত্যায়িত নথি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার শাখায় জমা দিতে হয়। এই পর্যায়ে, মন্ত্রণালয় নথির বিশদ বিবরণ যাচাই করে এবং অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেশন প্রদানের জন্য প্রস্তুত করে।
৩. অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেশন: মন্ত্রণালয় নথির বৈধতা যাচাই করে এবং অ্যাপোস্টিল স্ট্যাম্প বা সিল প্রদান করে। এই স্ট্যাম্পটি নথির পিছনে বা একটি পৃথক পৃষ্ঠায় সংযুক্ত করা হয়।
৪. ফি প্রদান: অ্যাপোস্টিল প্রক্রিয়ার জন্য নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হয়। ফি নথির ধরন এবং সংখ্যার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ফি-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।
৫. নথি সংগ্রহ: অ্যাপোস্টিল সম্পন্ন হলে, নথি মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে, কুরিয়ার সার্ভিস বা অন্য মাধ্যমেও নথি পাওয়া যেতে পারে।
কোন নথি অ্যাপোস্টিল করা যায়?
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নথি অ্যাপোস্টিল করা যায়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ব্যক্তিগত নথি: জন্ম সনদ, বিবাহ সনদ, মৃত্যু সনদ, বিবাহবিচ্ছেদের নথি। শিক্ষাগত নথি: এসএসসি/এইচএসসি সার্টিফিকেট, ডিগ্রি সনদ, ট্রান্সক্রিপ্ট। আইনি নথি: পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি, চুক্তিপত্র, আদালতের রায়। বাণিজ্যিক নথি: ব্যবসায়িক লাইসেন্স, রপ্তানি সনদ, বাণিজ্যিক চুক্তি।
অ্যাপোস্টিলের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব:
১. বিদেশে পড়াশোনা:
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করার সময় শিক্ষাগত সনদ অ্যাপোস্টিল করা প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করে যে আপনার সনদ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রহণযোগ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ভর্তির জন্য এটি অপরিহার্য।
২. চাকরি:
বিদেশে চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত এবং পেশাগত সনদের বৈধতা প্রমাণের জন্য অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন। এটি নিয়োগকর্তাকে নিশ্চিত করে যে আপনার নথি সঠিক এবং জাল নয়।
৩. অভিবাসন:
অভিবাসন প্রক্রিয়ায়, যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে, জন্ম সনদ, বিবাহ সনদ, বা অন্যান্য ব্যক্তিগত নথি অ্যাপোস্টিল করা প্রয়োজন। এটি অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে নথির সত্যতা প্রমাণ করে।
৪. আইনি প্রক্রিয়া:
আন্তর্জাতিক আইনি কার্যক্রমে, যেমন সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ, উত্তরাধিকার, বা চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে, অ্যাপোস্টিলকৃত নথি প্রয়োজন হয়।
৫. ব্যবসায়িক কার্যক্রম:
ব্যবসায়ীরা যখন বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান, তখন বাণিজ্যিক নথি অ্যাপোস্টিল করা প্রয়োজন। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত কর
৬. বিদেশি কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন
যখন আপনি একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, কোম্পানি বা সরকারি সংস্থায় কোনো ডকুমেন্ট জমা দেন (যেমন: জন্ম সনদ, ডিগ্রি, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স), তারা চায় ডকুমেন্টটি আপনার দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা যাচাই করা হোক। অ্যাপোস্টিল সিলটি সেই বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়।
৭. পারিবারিক কাজে বিদেশে স্থায়ী বসবাস:
ভিসা আবেদন, শিশু দত্তক নেওয়া, বিদেশে বিয়ে নিবন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আপনার পার্সোনাল ডকুমেন্ট অ্যাপোস্টিল ছাড়া গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
সুতরাং একজন সচেতন নাগরিক কিংবা বিদেশে শিক্ষা অর্জনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালনকারী ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এনিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে এবং সচেতনতা মূলক কর্মসূচিও পালন করে যাচ্ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও ব্যতিক্রম নয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপোস্টিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত শনিবার (২৮ জুন) উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী যারা অধিকতর শিক্ষা ক্যারিয়ার গঠন ও অভিবাসন প্রত্যাশী তাদেরকে নিয়ে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। এসময় উপাচার্যের বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, এই বিষয়টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত জরুরী একটি ইস্যু হলেও এ বিষয়ে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী এমনকি পেশাজীবী যারা লেখাপড়া বা অভিবাসন প্রত্যাশী হন, দেশের বাইরে গিয়ে তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে হয়। উপাচার্য সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে অ্যাপোস্টিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করা, প্রক্রিয়াটি কোথায়, কিভাবে এবং কত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়, সে বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং অনলাইন আবেদন ও ট্র্যাকিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের উপর জোর দেন। তিনি সেবা-গ্রহীতাদের অভিজ্ঞতা, সুবিধা-অসুবিধা ও সুপারিশ সংগ্রহের মাধ্যমে অ্যাপোস্টিল প্রক্রিয়াকে আরও জনবান্ধব ও সময়োপযোগী করার নিদের্শনা দেন। তিনি এ বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে আরও সচেতন হবার আহ্বান জানান।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও চাকরিপ্রত্যাশী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সনদ অনলাইনে সত্যায়নে ব্যবহৃত অ্যাপোস্টিল প্লাটফর্ম ও ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষিাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে গত ১৪ নভেম্বর (২০২৪) ইউজিসি অডিটরিয়ামে ‘দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত ডিগ্রি নিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সনদ অনলাইনভিত্তিক অ্যাপোস্টিল প্লাটফর্মে সত্যায়ন’ শীর্ষক এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এসময় তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘অ্যাপোস্টিল প্লাটফর্ম এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের সনদ সত্যায়নে কোন বিতর্ক তৈরি না হয়। সনদ সত্যায়নে এই পদ্ধতি ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে। এতে শিক্ষার্থীদের সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হবে এবং তাদের ভোগান্তি কমবে।’
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপোস্টিল কনভেনশনে যুক্ত হয়েছে গত ২৯ জুলাই (২০২৪) নেদারল্যান্ডসে অ্যাপোস্টিল কনভেনশনে যোগদানের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে ‘ইন্সট্রমেন্ট অভ একসেশন’ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
আজকালের খবর/ওআর