
ফেনীতে চলমান বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহের ৭ জুলাই শুরু হওয়া ভারি বর্ষণ এবং ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে বন্যা রক্ষা বাঁধের ২১টি স্থানে ভাঙনে ফেনীতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। ১০ জুলাই থেকে বৃষ্টিপাত কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। বন্যার পানি নেমে আসার পর রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন খামারে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বন্যার প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। ওই প্রতিবেদনে শুধু পুকুর ভেসে গিয়ে মাছের খামারিদের ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রতিবেদনে মুরগি, গরু, ছাগল ও মহিষের মৃত্যুতে ৬৪ লাখ টাকার সম্পদহানি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনে সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিভাগ, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। পানি গড়িয়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীণ অনেক সড়ক থেকে পানি নামার পর বড় বড় গর্ত থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। অনেকেই বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে সহায়তার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
এদিকে গতকাল ফেনীতে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। এ সময় তিনি বলেন, ‘ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার প্রকল্পটি সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাস্তবায়ন করার কথা ভাবছে সরকার। বাঁধের কাজ এক নম্বর হতে হবে।
সকাল ১০টার দিকে ফেনীর ফুলগাজী আলী আজম উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এটি কোনো ছোটখাটো কাজ নয়, অনেক বড় প্রকল্প। সুতরাং এটির জন্য কারিগরি দক্ষতা থেকে শুরু করে আয়োজন-উদ্যোগ সবকিছুই এক নম্বর হতে হবে। কারণ বারবার এত বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করা যাবে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেও সময় লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো অসংগতি রয়েছে কিনা, সবাই যেন ত্রাণ সহায়তা যথাযথ পান সেজন্য দেখতে এসেছি। এছাড়া কীভাবে কাজ করলে এটি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে তা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে শুনেছি। সরকারও তাদের কথা শুনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর আগে বানভাসি মানুষের সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন উপদেষ্টা। এছাড়া ফুলগাজীর মুন্সিরহাটে আজমিরি বেগম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র ও দক্ষিণ শ্রীপুর পূর্বপাড়া এলাকায় মুহুরী নদীর ভাঙন স্থান পরিদর্শন করেন তিনি।
এর আগে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে ফেনী সার্কিট হাউজে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় অংশ নেন উপদেষ্টা। এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, গত ৭ জুলাই সোমবার বিকাল থেকে ফেনীতে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় মঙ্গলবার থেকে ফেনীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মাঝে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মঙ্গলবার রাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি স্থান ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হতে থাকে। সর্বশেষ ফুলগাজী ও পরশুরাম এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙ্গে চার উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, আসবাবপত্র, গবাদিপশুসহ সবকিছু বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কাপড়ে মানুষ জেলার অর্ধশতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে ওঠে। প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যক্তিরা বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার কার্যক্রম, খাবার, পানীয় পৌঁছে দেয়াসহ মানবিক সেবা প্রদান করে। ১০ জুলাই থেকে বৃষ্টিপাত কমতে থাকলে ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়। তবে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বন্যার পানিতে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন তলিয়ে যায়। গতকাল এ প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে ফুলগাজী ও পরশুরামের মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়িঘরে ফেরা শুরু করলেও ফেনী সদর উপজেলা ও ছাগলনাইয়ার অনেক মানুষ এখনো আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়তে পারেনি। এখনো জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে এ দুই উপজেলার রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বাঁধভাঙা পানিতে জেলার সব উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে জেলায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর ডুবে অন্তত ৮ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার মাছ ও ২ কোটি ৮১ লাখ টাকার পোনা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এর বাইরে খামারিদের প্রায় অর্ধকোটি টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভেসে যাওয়া পুকুরের তথ্য প্রস্তুত করে প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘গত কয়েকদিনের বন্যায় জেলায় প্রায় ৬৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য উঠে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতির মাঝে চারটি গরু, তিনটি ছাগল, একটি ভেড়া, সাড়ে ১০ হাজার খামারের মুরগি ও ২৩৫টি হাঁস মারা যাওয়ার তথ্য পেয়েছি। এর বাইরে বন্যাকবলিত হয়ে অন্তত ২০ হাজার গরু, মহিষ, ছাগলসহ গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণও কম নয়।’ তিনি বলেন, ‘এটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নয়। বন্যা এখনো শেষ হয়নি। দিন দিন এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১০ জুলাই পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্যের আলোকে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলায় চলমান বন্যায় ৮৪৫ হেক্টর আউশ ধানের জমি, ৫৩৭ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি, ১৪ হেক্টর মরিচ, ৭ হেক্টর আদা, আড়াই হেক্টর হলুদ, ১১ একর টমেটো, ৬৮৯ হেক্টর বীজতলা ও ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে বস্তায় চাষ করা আদা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। একই দিন পর্যন্ত কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির টাকার অংক নিরূপণ করতে পারেনি। পানি নেমে গেলেই চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যা এখনো শেষ হয়নি। কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির একটি বিবরণী আমাদের দিয়েছে। এটিকে আমরা চূড়ান্ত ভাবছি না। এখনো জেলার অনেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য হাতে পাব। দুর্গত এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আজকালের খবর/ওআর