মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
আমাজনের ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্থ পৃথিবী
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫, ৪:৩৭ পিএম
পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিশ্বের বনাঞ্চলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বৃহত্তর বন আমাজন। মহাবন আমাজন বিশ্বের বিষ্ময়। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত এক বিশালাকার বনভূমি আমাজন। এই বনের দীর্ঘায়তন এবং বনের প্রকার দেখে এক সময় স্থানীয়রা ধারণা করতো এই বন ধ্বংস করা সম্ভব না। কিন্তু বাস্তবতা হলো পৃথিবীর আর দশটা বনের মতো আমাজনও সংকুচিত হতে শুরু করেছে এবং তা বর্তমানে অতিমাত্রায়। ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রবাবিত। ৯টি দেশ জুড়ে এই বন বিস্তৃত রয়েছে। তবে অধিকাংশ অর্থাৎ ৬০ ভাগ রয়েছে ব্রাজিল অংশে। এছাড়া ১৩ শতাংশ পেরুতে রয়েছে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসিম গায়ানায়। পৃথিবীজুড়ে রেইনফরেষ্টের অর্ধেকই আমাজনে। ফলে আমাজনের ক্ষতি কোনো একক দেশকে প্রভাবিত করে না। এই বন পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত। সুন্দরবন যেমন বাংলাদেশের ফুসফুস তেমনি আমাজন পৃথিবীর ফুসফুস। ফলে আমাজনের ক্ষতি আমাদের বিশ্বের জন্যই ক্ষতি। প্রতি নিয়তই প্রাকৃতিক ও মানুষের আত্নঘাতী কর্মকাণ্ডের কারণে আমাজন সংকুচিত হচ্ছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে আমাজন উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৌছেছে। ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে বন ধ্বংসের হার পৌঁছেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্ল্যাড ল্যাব’-এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর দাবানলের কারণে বন উজাড়ের হার বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। এই বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’ প্ল্যাটফর্ম। গবেষণায় বলা হয়, ২০২৪ সালে ব্রাজিলের আমাজন থেকে শুরু করে সাইবেরিয়ার বরফাচ্ছন্ন তাইগা পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ বন উজাড় হয়েছে। কৃষিকাজ, দাবানল, খনি প্রকল্প ও কাঠ সংগ্রহের কারণে পৃথিবী হারিয়েছে ইতালির আয়তনের সমান বনভূমি। গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ম্যাট হ্যানসেন এই পরিসংখ্যানকে ‘ভীতিকর’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘বিশ্ব এখন এক বিপজ্জনক চক্রে ঢুকেছে, যেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বন আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে। আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়ছে এবং নিয়ন্ত্রণ হারানো আগুনে পুরো রেইনফরেস্ট ছাই হয়ে যাচ্ছে।’

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাই মাঝে মধ্যেই প্রকৃতির ধ্বংসলীলা চলে। এই ধ্বংসলীলার জন্য আজ পৃথিবীতে বহু মানুষ গৃহহীন। মহাবন আমাজন প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। ব্রাজিলে অবস্থিত এই বন সম্পর্কে একসময় বলা হতো এই বন কখনো ধ্বংস হবে না। বই-পুস্তকে আমাজন নিয়ে বহু লেখা আমরা পড়েছি। বহু কল্পকাহিনী, সিনেমা এই আমাজন বন ঘিরে তৈরি হয়েছে। তবে মানুষের ক্রমবিকশিত সভ্যতার কার্যকলাপে আমাজানও সংকুচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই মহাবন সংকুচিত হতে শুরু করেছে। মানুষের লোভের ভয়াল থাবা। আমাজনে প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখি রয়েছে; পাশাপাশি, ১০ লাখ আদিবাসী মানুষের বসতি সেখানে রয়েছে। এই মহাবন বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১২ হাজার ২৩৫ বর্গকিলোমিটার বনভূমি উজাড় হয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে এটিই সর্বোচ্চ বনাঞ্চল ধ্বংসের ঘটনা। ২০২০ সালে বেআইনিভাবে  খননকাজ এবং গাছ কেটে কৃষি জমি তৈরি করার কারণে বন নিধন চরমভাবে বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে যে পরিমাণ বন ধ্বংস হয়েছে, ২০২১ সালেও একইভাবে আরও ৭ হাজার ৮৮০ বর্গকিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে।  

আমাজনের ওপর নির্ভর করে আছে নানা রকম প্রাণীকুল। বৈচিত্র্য সম্ভারে আমাজনের দ্বিতীয়টি নেই। একটি বিষয় স্পষ্ট যে আমাজনের আজকের এই পরিণতির জন্য মানুষের লোভ এবং লাভের হিসাবই দায়ি। যে আমাজনের ওপর পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের একটি বড় অংশ নির্ভরশীল সেখানে মানুষের জন্য আজ পৃথিবীর ফুসফুসের এই পরিণতি। এই সুন্দর পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যে গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে অচিরেই পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ ভয়াবহ সংকটে পরতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও অধিকাংশ দেশের জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিযোজন শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। ২০২৩ সাল ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। তার সঙ্গে এল নিনোর প্রভাবে আমাজনে খরা ভয়াবহ রূপ নেয়। চাষিরা যখন জমি পরিষ্কার করতে আগুন দেন, তা অনেক সময় দাবানলে রূপ নেয়। এর ফলে শুধু ২০২৩ সালেই প্রায় ১.১৫ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়েছে- যা পুরো দক্ষিণ আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনের চেয়েও বেশি। এই অবস্থার ভিতরেও পৃথিবীতে বন ধ্বংস করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বলিভিয়ায় বন ধ্বংস বেড়েছে ২০০ শতাংশ। দেশটি গরুর মাংস ও সয়াবিন চাষে আগুন দিয়ে জমি পরিষ্কারের অনুমতি দিয়েছে। ২০২৪ সালে দেশটি হারিয়েছে ১৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার বন, যার দুই-তৃতীয়াংশ দাবানলে নষ্ট হয়েছে।

পেরুর বন সংরক্ষণের আইন শিথিল করায় ধ্বংস বেড়েছে ২৫ শতাংশ। কলম্বিয়ায় বিদ্রোহীদের সোনা খনন ও কোকা চাষের কারণে প্রাথমিক বন ধ্বংস বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। এমনকি সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে পরিচিত গায়ানাতেও বন ধ্বংস বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও কঙ্গো-ব্রাজাভিলেতেও বন ধ্বংসের হার সর্বোচ্চ। এই অঞ্চলের রেইনফরেস্ট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা পরিবেশ সংকটকে আরো তীব্র করে তুলছে এবং বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটকে ত্বরান্বিত করছে। যদিও বিশ্ব একমত হয়েছিল বৈশ্বিক সংকটে বন উজাড় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে। ২০২১ সালে গ্লাসগোর কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের চিত্র বলছে, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে ২০ শতাংশ হারে বন ধ্বংস কমাতে হবে। যদিও ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় বন ধ্বংসের হার তুলনামূলকভাবে কম। এমনকি মালয়েশিয়া এবার প্রথমবারের মতো শীর্ষ দশ বন ধ্বংসকারী দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

পৃথিবীর বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একসময় সুশীতল, বিষমুক্ত ছিল। সেই আগের মতো বাযুমণ্ডল পেতে হলে পক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বায়ুমণ্ডল হয়ে উঠবে সেই ১০০ বছর আগের মতো। এমনটাই জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণা। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স’ এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র গাছ লাগালেই আসন্ন সংকট থেকে সমাধান সম্ভব। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে অনেরক নিচু শহর মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। আর শিল্পায়নের জোয়ারে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়েই চলেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এক লাখ কোটি গাছ লাগাতে জমির অভাব হবে না। হিসেব করে দেখিয়েছে, যদি আপনার সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকে দ্রুত এক লাখ কোটি গাছ বসিয়ে ফেলার তাহলে অন্তত জায়গার অভাবে সেসব গাছের বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।  

২০১৯ সালে বোলসোনারো সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে মাত্র এক বছরেই। যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। যদিও বলসোনারো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনবেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ তার সময়েই খনিতে খনন কাজ এবং কৃষিজমি তৈরির কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার না কমালে আমাজনের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। একদিকে আমাজনকে রক্ষা করা অন্যদিকে কৃষি জমি তৈরি করে খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া এবং খনির অর্থনীতি কাজে লাগানো। এতসব একসাথে মেলানো অনেকটাই কষ্টকর কাজ হবে। তাছাড়া এই বনে যেসব অধিবাসীর বাস তাদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে আদিবাসীদের সাথে স্থানীয়দের সংঘর্ষ ঘটতে পারে এবং এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর প্রতিটি বন এমন সম্পদ যার মাধ্যমে এই পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। দ্রুত নগরায়ন প্রক্রিয়ায় সারা পৃথিবী থেকেই বনভূমি উজাড় হচ্ছে। গড়ে উঠছে মানুষের বসতি। তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। খাদ্য নিরাপত্তা দিতে তৈরি হচ্ছে কৃষি জমি। অথচ আমাদের এই মুহূর্তে দরকার পরিকল্পিত বনায়ন। বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনা প্যারিস চুক্তির লক্ষ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এত দ্রুত প্রতিকুল দিকে ধাবিত হচ্ছে যেখানে বিশ্ব শীতলিকরনের জন্য আমাজনের গুরুত্ব অপরিসীম।    

 
অলোক আচার্য: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।  

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
কক্সবাজারে জামায়াত নেতার হামলায় বিএনপি নেতা নিহত
এই সম্মান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকবে: আনোয়ারা
৯৬ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া
বাউল শিল্পী মো. নূর হোসেনের সংগীতযাত্রা
বাউল শিল্পী মিজানুর রহমানের গান হৃদয়ে ঢেউ তোলে
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার সভাপতি মমিনুর রশীদ, মহাসচিব কামরুল ইসলাম
ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৩০
এরশাদের স্মরণসভায় একমঞ্চে পাঁচ অংশের নেতারা, জাপা গড়ার প্রতিশ্রুতি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft