নির্বাচন দেরি হলে দেশে ‘মবোক্রেসি’ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সময়মতো নির্বাচন না হলে দেশ পিছিয়ে যাবে, বিচার ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে। নির্বাচনে যত দেরি হবে, দেশ তত পিছিয়ে যাবে। বিনিয়োগ আসবে না, নারীরা নিরাপত্তা হারাবে, জুডিশিয়াল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সেজন্য দরকার একটা নির্বাচিত সরকার। যেই সরকারের পেছনে রয়েছে জনগণ।
সোমবার (৭ জুলাই) সকাল ১০টায় সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। এরপর বিএনপির মহাসচিব হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজারও জিয়ারত করেন। তিনি সিলেটে বারবার আসার কথা উল্লেখ করে বলেন, সত্য, সুন্দর ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.)। সেজন্য আমরা তাদের দরগায় আসি। কারণ এই মহান পুরুষরা অন্ধকারকে আলোকিত করেছিলেন। একই কারণে সারা দেশ থেকে মানুষ আসে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও দেশের বিভিন্ন দলকে উদ্দেশে করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে দেশ তত পিছিয়ে যাবে। বিনিয়োগ আসবে না, মায়েরা-মেয়েরা নিরাপত্তা হারাবে, জুডিশিয়াল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সেজন্য দরকার একটা নির্বাচিত সরকার। যেই সরকারের পেছনে রয়েছে জনগণ। নির্বাচিত সরকারের চেয়ে কোনো সরকার শক্তিশালী হতে পারে না।
এরপর নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় সানরাইজ কমিউনিটি সেন্টারে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এমএ মালেক সভাপতিত্বে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেন, মানুষের কাছে যান। মানুষ যাতে বুঝতে পারে বিএনপি ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর কত নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবেন? এখন সময় এসেছে মানুষের কাছে যাওয়ার। আমরা চাই, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে কথা বলে ছাব্বিশের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচনের একটা সময় ঠিক করেছেন। তিনি বলেন, পরিষ্কার করে বলতে চাই, সরকারকে বলতে চাই, অন্য রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, নির্বাচন যত দেরি হবে, তত বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে।
দ্রুত নির্বাচন না হলে বিভিন্ন সংকট দেখা দেবে জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, দেশে বিনিয়োগ আসবে না। ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ) হবে না। আমার মায়েরা-মেয়েরা আরও বেশি নিরাপত্তা হারাবে। মবোক্রেসি আরও বাড়বে। জুডিশিয়াল সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়বে। সে জন্য দরকার একটি নির্বাচিত সরকার। যে সরকারের পেছনে মানুষ আছে, সে সরকারের পেছনে জনসমর্থন আছে। নির্বাচিত সরকারের চাইতে শক্তিশালী কোনো সরকার হতে পারে না।
মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে বলেন, শেখ হাসিনা একদিনে হঠাৎ করে পালাননি, বহু মানুষের সংগ্রাম, রক্ত, ত্যাগ মিলিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত হলাম। এজন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে মানুষ কথা বলতে পারবে, নারীরা নিরাপত্তা পাবে, তরুণরা কাজের সুযোগ পাবে, মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। শেখ মুজিব একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, চারটি রেখে সব মিডিয়া বন্ধ করেছিলেন। এ অবস্থা থেকে জিয়াউর রহমান মানুষের গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি বলেন, আমরা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কথা বলতে পারবে, বাকস্বাধীনতা থাকবে, নারীরা নিরাপত্তা পাবে, তরুণরা কাজের সুযোগ পাবে, মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাবে। এমন একটা দেশ আমরা চাই। সেই দেশ তৈরির জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করেছি। আর আমাদের এই সংগ্রামের নেতা হচ্ছেন তারেক রহমান। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখনো অসুস্থ অবস্থায় আমাদের পরমার্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, হাসিনা গণতন্ত্র, ভোট, পত্রিকা বন্ধ করেছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এনে নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমরা সেই দল সেই যে দল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই, কর্মস্থান সৃষ্টি করতে চাই এবং বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্র করতে চাই। সেজন্য বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছি। আর এই ৩১ দফার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের সময় ঠিক করেছেন, এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, কেউ যাতে আঙ্গুল তুলে কথা না বলতে পারে আমরা জমি দখল করেছি, চাঁদাবাজি করেছি, জায়গা দখল করেছি। জয় আমাদের সুনিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেন। মানুষের কাছে যান। মানুষ যাতে বুঝতে পারে বিএনপি ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। এই জিনিসটাকে আমাদের তৈরি করতে হবে। সেই জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
তিনি ঘোষণা করেন, সিলেটে যেখানে বেগম খালেদা জিয়া সমাবেশ করেছিলেন সেখানে এবার তারেক রহমানকে নিয়ে দেখা হবে।
২০২৪ এবং এর আগের ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য অনেকে বুকের রক্ত রাস্তায় ঢেলে দিয়েছিলেন উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাদের নেতা যারা এখানে বসে আছেন, তাদের অনেককে পায়ে-হাতে দড়ি লাগিয়ে মাসের পর মাস কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে এই সিলেটে। অনেককে পিটিয়ে পিটিয়ে শরীর জর্জর করেছে হাসিনা সরকার। হাতে-পায়ে বেড়ি দিয়ে আটকে রাখত। এই অত্যাচার–-নির্যাতন সহ্য করে আমরা এখন এখানে।
বাংলাদেশ কি চিরকাল দরিদ্র দেশ হয়ে থাকবে? চিরকাল নিচে পড়ে থাকবে? এমন প্রশ্ন রেখে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা সেই বাংলাদেশ দেখতে চাই, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে তিনি খাল কেটেছিলেন গ্রামে গ্রামে গিয়ে। সে বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই, যে বাংলাদেশের জন্য আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া গ্রামে-গ্রামান্তরে চারণকবির মতো গণতন্ত্রের গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলেন। আমরা সেই স্বপ্ন দেখতে চাই।
বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যখন সুযোগ পাই সিলেট আসি। কারণ হচ্ছে, শত শত বছর পূর্বে এখানে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। সত্য, সুন্দর ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.) দরগায় আমরা আসি। শুধু আমরা না সারা দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষ এখানে আসে।
তিনি বলেন, এটা আমাদের পুণ্যভূমি। সিলেট আমাদের কাছে আরও প্রিয় হওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেবের শ্বশুরবাড়ি। সেজন্য আমরা এখানে আসতে আনন্দ পাই, শান্তি পাই। এ সময় তিনি ইলিয়াস আলীসহ সব গুম হওয়া নেতাদের কথা স্মরণ করেন।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করে হাসিনামুক্ত হয়েছি। কিন্তু এখনো ষড়যন্ত্র মুক্ত হতে পারিনি। বিএনপির বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছিল তারা এখন নানা কথা বলছে।
নগর বিএনপি সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী ও প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমদ সিদ্দিকীর পরিচালনায় মাহফিলে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ডা. এ জেড এম জাহিদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান, তাহসিনা রুশদীর লুনা, ড. এনামুল হক চৌধুরী, মাইজুর রহমান, ডা. শাখাওয়াত হাসান জীবন, সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার এমএ সালাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন ও মিফতাহ সিদ্দিকী, কেন্দ্রীয় সহ-ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, কেন্দ্রীয় সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী, আবুল কাহের শামীম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সাদিয়া চৌধুরী মুন্না, জেলা সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও নগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান লোদী কয়েস।
আলোচনা সভায় শেষে পরে বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও তারেক রহমানের দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ঢাকা থেকে সিলেটগামী একটি ফ্লাইটে মির্জা ফখরুল সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে পাঠানটুলা এলাকার সভাস্থলে যান। এ সভাশেষে বিকালে নগরের দরগাগেট এলাকার একটি হোটেলে সিলেট জেলা বিএনপি আয়োজিত জুলাই-আগস্টে সিলেট জেলায় শহীদ বীর সন্তানদের বিশেষ স্মরণ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সম্মাননা অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী।