মূল্যস্ফীতি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন নয় দশমিক এক শতাংশ, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাত্ত্বিকভাবে দুই কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটে। যেমন চাহিদা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। কোভিড অতিমারীর ধাক্কা অনেকটা কেটে গেলে গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতে শুরু করলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরবরাহ সঙ্কট এবং উৎপাদন কম থাকায় সে সময় থেকেই বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। এরপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে তীব্র জ্বালানিসঙ্কট দেখা দেয় এবং এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে বিশ্বব্যাপী গমসহ খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বিশ্বে একই সময়ে চাহিদাজনিত (ডিমান্ড পুল) ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির (কস্ট পুল) কারণে মূল্যস্ফীতি
অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। গত জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শেষ তিন মাসে বৃদ্ধির গতি অনেকটাই অসহনীয়। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি দুই থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে থাকা জনজীবনের জন্য স্বস্তিদায়ক বা ভালো। সাত থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা মানেই বিপদ এবং এর চেয়ে বেশি হলে মহাবিপদ।
মূল্যস্ফীতি মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও জনজীবনে অসহনীয় অস্বস্তি। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে টিকে থাকা কঠিন। গত মে মাসেই মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জুন মাসে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন সাত দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সাত দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। অর্থাৎ বিগত নয় বছরে এই জুন মাসের মতো এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি।
অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বলতে সাধারণত মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। কারণ অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তর দুটিই বেড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে এবং এতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়। তবে শুধুমাত্র একটি, দুইটি বা সামান্য কয়েকটি দ্রব্য বা পরিষেবার যদি মূল্যবৃদ্ধি হয়, তবে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় না। সামগ্রিকভাবে জিনিসপত্র এবং পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি হলে তবেই বলা হয় মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় বর্তমানে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সারা বিশ্বে প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এই অবস্থা হলো মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা।
মুদ্রাস্ফীতিকে অন্যভাবেও ব্যাখা করা যায়। যদি কোনো মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাহলে সেই অবস্থাকেও মুদ্রাস্ফীতি বলা চলে। যেমন ২০১২ সালে এক কেজি চালের দাম ছিল ২৫ টাকা অথচ ২০২২ সালে এক কেজি চালের দাম ৫০ টাকা। অর্থাৎ ২০১২ সালে ২৫ টাকায় যে পরিমাণ চাল পাওয়া যেত, আজ ২০২২ সালে ওই একই টাকায় তার চেয়ে কম পরিমাণ চাল পাওয়া যায়। এর অর্থ হলো মুদ্রার ক্ষমতা বা তার মূল্যের অবনমন হয়েছে, যার ফলস্বরূপ মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়েছে।
সাধারণত দুটি কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। প্রথমত, চাহিদা বৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি-এক্ষেত্রে যদি কোনও দেশে পণ্য ও পরিষেবার সুবিধা নেওয়ার চাহিদা বৃদ্ধি পায় অথচ সেই অনুপাতে পণ্যের উৎপাদন বা পরিষেবা সরবরাহ না থাকে, তাহলে যেটুকু পণ্য ও পরিষেবা পর্যাপ্ত আছে, তার মূল্য বৃদ্ধি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হয়। আমরা জানি যদি কোনো জিনিস খুব স্বল্প পরিমাণেই সরবরাহ থাকে অথচ তার চাহিদা বেশি, তাহলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মই সেই দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হবে। এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা তৈরি হতে পারে যদি সরকার আয়কর কমিয়ে দেয় বা সুদের হার হ্রাস করে, অথবা কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি হয়। দ্বিতীয়ত, মূল্যবৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতি- এক্ষেত্রে যদি কাঁচামাল অথবা সেই সব পণ্য বা পরিষেবা যার ওপর কোনো দেশের অর্থনীতি প্রবলভাবে নির্ভরশীল তার মূল্যবৃদ্ধি হয় তবে মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেমন ধরা যাক, কোনো দেশে পেট্রোল বা ডিজেলের দাম বৃদ্ধি হলো। এখন যে কোনো খাদ্যদ্রব্যই হোক বা বিলাসবহুল দ্রব্য সবই শেষমেষ গ্রাহকের নিকট পৌঁছায় যানবাহনের মাধ্যমে, আবার যানবাহন চলে পেট্রোল বা ডিজেলে। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়লে অন্যান্য জিনিসেরও মূল্য বৃদ্ধি হবে, কারণ তখন গ্রাহক অবধি দ্রব্য পৌঁছাতে পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে। আবার এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যদি শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হয়, বা সরকার কর বৃদ্ধি করে, অথবা এইরূপ অন্যান্য কারণগুলির জন্যও। মুদ্রাস্ফীতির অন্যান্য কারণগুলো হচ্ছে অর্থের যোগান বৃদ্ধি, উৎপাদন হ্রাস, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও মহামারি, যাতায়াত ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মজুদদার ও চোরাকারবারি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উদার ঋণনীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি।
মুদ্রাস্ফীতি সমাজে আয় বণ্টনের বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে, সামাজিক অসন্তোষের সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার প্রধানত দুই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। প্রথমত, আর্থিক নীতি- মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে এ লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক নীতির সাহায্যে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয় সেই ব্যাংক হার বৃদ্ধি, খোলাবাজার নীতির মাধ্যমে খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব নীতি- বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক নীতি অপেক্ষা রাজস্ব নীতি অনেক বেশি কার্যকরী। মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যয়। মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে। আবার, চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জনগণের ওপর আরোপিত করের মাত্রা বৃদ্ধি করে কিংবা নতুন নতুন কর আরোপ করে জনগণের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমাতে পারে। অর্থনীতিতে খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে বা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার উৎপাদন ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ-মুদ্রাস্ফীতির সময়ে সরকার দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূলত পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছয় শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আসলে আরো বেশি। বিশেষ করে গরিব মানুষের ওপর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের বেশি।
কয়েক মাস ধরেই বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বাজারে সব ধরনের পণ্যেরই দাম বাড়তি আছে। এর ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। এসব কারণে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য আবারো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত জুন মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত-দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল আট দশমিক ৩০ শতাংশ। আর জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ছয় দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ছয় দশমিক শূন্য আট শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। একই সময়ে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ছয় দশমিক ৬২ শতাংশ। একই তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে আট দশমিক ৯৩ শতাংশে। শহরাঞ্চলে এই হার সাত দশমিক ১১ শতাংশ।
আসলে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে একধরনের বোঝা বা করের মতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা বহু মানুষের আবার গরিব হওয়ার শঙ্কা থাকে। বিবিএসের মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় মজুরি সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। কয়েক মাস ধরেই এর ব্যতিক্রম লক্ষ্যণীয়। বিবিএস বলছে, ২০১০-১১ ভিত্তিবছর ধরে গত জুন মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছয় দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। অর্থ্যাৎ যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেই হারে মজুরি বাড়ছে না। ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
এ ছাড়া, গত নভেম্বর মাসে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ অতিক্রম করে। অবশ্য জানুয়ারি মাসে তা আবার ছয় শতাংশের নিচে নেমে যায়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের নামমাত্র আয় বৃদ্ধি পায় যদিও আসল আয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না, কারণ মুদ্রাস্ফীতির জন্য মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে এবং সাধারণ মানুষ কম খরচ করে। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে অপরিহার্জ্য নয় এমন দ্রব্যে খরচ কমিয়ে দেন। মুদ্রাস্ফীতির ফলে কর্মসংস্থান সাময়িক ভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে জিনিসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পায এবং এর ফলে কারখানাগুলি আরও বেশি দ্রব্য উৎপাদন করে বেশী মুনাফা কামাতে চায় এবং এর জন্য তারা আরো বেশি কর্মচারি নিয়োগ করে। স্বভাবতই, এর ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। যদিও এই বৃদ্ধি স্বল্পকালীন মেয়াদের জন্য। দীর্ঘকালীন মেয়াদে কর্মসংস্থানে কোনো প্রভাব পড়ে না বা কর্মসংস্থানের হার কমে যায়। তা ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির ফলে সেই দেশে উৎপন্ন পণ্যের রপ্তানী বৃদ্ধি পায়, কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মূল্য কমে যায়। অন্যদিকে এর ফলে অন্য দেশ থেকে আমদানির পরিমাণ কমে যায়। কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে সেই দেশের মুদ্রার মূল্য কমে যায় ফলে বিদেশি জিনিসগুলি কিনতে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হয়।
এদিকে ছয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে গত অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক চার শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) গড়ে ছয় দশমিক ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঠিক থাকেনি। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশে রাখবেন বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন। উচ্চমূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কম। বর্ষাকালে বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে মূল্যস্ফীতি একটু বাড়ে। কারণ, এ সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ধান, শাকসবজির মৌসুম নয় বলে বাজারে এসবের দাম কিছুটা বাড়ে। মূল্যস্ফীতির চক্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময় সাধারণত খাদ্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
তবে সরকার যাই বলুক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তা।
জিল্লুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ