রবিবার ২০ এপ্রিল ২০২৫
ক্রিয়েটিভ সামিট : রিফর্মের নামে বিভাজন কেন?
আহমেদ তেপান্তর
প্রকাশ: সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ৭:৩৭ PM
আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘ফেবফেস্ট’ বা ‘ক্রিয়েটিভ সামিট’ নামের একটি আয়োজন হতে যাচ্ছে। ‘সংস্কৃতি’ অঙ্গন এবং ‘অবাণিজ্যিক’ ধারার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উদ্যোগে ফিল্ম অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের (বিএফএ) ব্যানারে এই আয়োজন। এতে সঙ্কটের আবর্তে থাকা ‘চলচ্চিত্র’কে তারা মূল এজেন্ডা হিসেবে ফোকাস করতে চাইছেন। আর এতে যোগ করেছেন নতুন করে ওটিটিকেও।

গত ১৯ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে এই আয়োজনের দিনক্ষণ জানিয়েছেন তারা। এ সময় তারা এই সংগঠন ও ফেস্টের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

তাদের এই আয়োজন এমন এক সময় হতে যাচ্ছে যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) অন্তর্গত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্বনামে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরোনো অসংখ্য মহীরুহ পরিচালকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি’। যারা স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করেছেন সেলুলয়েডে। ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, রক্তাক্ত বাংলা, আবার তোরা মানুষ হ, ভাইয়া, নয়ন তারা, ময়নামতি, মধু মিলন, অবুঝ মন, বধূ বিদায়, আলোর মিছিল, গোলাপী এখন ট্রেনে, সূর্য সংগ্রাম, সূর্য গ্রহণ, সূর্য দীঘল বাড়ী, দহন, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকত, এক মুঠো ভাত, বড় ভালো মানুষ ছিল, মহানায়ক, দি ফাদার, সারেং বউ, সবুজ সাথী, দি রেইন- এমন অসংখ্য সিনেমার সেলুলয়েডের ভাষায় সমৃদ্ধ আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। আশির দশকে যৌথ প্রযোজিত সিনেমাগুলোর দিকে যদি তাকাই তবে দেখা যাবে বিদেশি শিল্পীদের আরাধ্য ছিলো আজকের ‘তাচ্ছিল্যের’ শিকার বিএফডিসি। যে সিনেমাগুলো কেবল ব্যবসায়িকভাবে সমৃদ্ধ তা নয়, এগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায়ও সুদৃঢ় অবস্থান ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এ সিনেমা আর সংশ্লিষ্টদের ছাড়া ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।

এখন পর্যন্ত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার ব্যবসায়িক রেকর্ড ভাঙার মতো সিনেমা হয়নি। এই সিনেমার এতোটাই সমাদৃত হয়েছিলো যে সে সময় কলকাতায় হিন্দি সিনেমা পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। সিনেমাটি দেখতে টিকিট কেটেছিলেন, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন। অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন স্বয়ং! নির্মাতা তোজাম্মেল হক বকুল। তিনি বিএফডিসির একজন সদস্য ছিলেন।

বিংশ শতকে সামাজিক অ্যাকশান আর রোমান্টিক সিনেমার কলেবরে কিছুটা খেই হারিয়ে একবিংশ শতকের শূন্য দশকে তলানিতে ঠেকে বিএফডিসি। বন্ধ হয় হাজার খানেক সিনেমা হল। অস্থিরতার ঠেকাতে এফ আই মানিক নির্মাণ করেন ব্যাক টু ব্যাক ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘পিতার আসন’, ‘চাচ্চু’, ‘দাদীমা’র মতো সিনেমা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে মুক্তি পায় এস এ হক অলিকের ‘হৃদয়ের কথা’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ সিনেমা দুটি। যারা সকলেই সিনেমাকে লালন করা বিএফডিসিকেন্দ্রিক পরিবারের সদস্য। পরের বছর নাট্যনির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম নির্মাণ করেন নিটোল প্রেমের গল্পে ‘মনপুরা’। সিনেমাটি দর্শক রুচির গতানুগতিক ধারাটাই পরিবর্তন করে দেয়। অশ্লীলতার যুগে সিনেমাগুলো দর্শক সমাদৃত হয়। দর্শক ফিরতে শুরু করে। এ ধারাবাহিকতায় ব্যাক টু ব্যাক সিনেমা খুব একটা দেখা যায়নি। দর্শক রুচি নিয়ে অনেক নিরীক্ষা হয়েছে বটে খুব বেশি দর্শক টানা যায়নি। তবে তৃতীয় দশকের শুরুতে করোনাকালে সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে যে কটি সিনেমাকে অগ্রণী বলা যায় তার মধ্যে দেবাশীষ বিশ্বাসের ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, অনন্ত জলিল প্রযোজিক ও অভিনীত ‘দিন: দ্য ডে’, এস এ হক অলিকের সরকারি অনুদানের ‘গলুই’, রায়হান রাফির ‘পরাণ’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ প্রধান। এরমধ্যে সরকারি অনুদানের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন ‘গলুই’ সিনেমার প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু। সিনেমাটিতে আরো অতিরিক্ত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে টানা শুটিং করেছেন এবং যথা সময়ে মুক্তিও দেন। এ ছাড়া বিএফডিসি পরিবারভুক্ত যারাই অনুদান নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই যথারীতি কাজ করে সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন। মেরে কেটে খাওয়ার বা টাকা উত্তোলন করে নির্মাণ না করার যে প্রবণতা এই পরিবারে তার সংখ্যা অতি নগণ্য! এরমধ্যে শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই প্রশ্নের দাবি রাখে। সরকার কেবল সিনেমার সংখ্যা আর বিষয়ভিত্তিকের দিকে জোর দিচ্ছে, জবাবদিহি উহ্য থাকছে। এ নিয়মের সুযোগে অনুদান গ্রহীতারা যাচ্ছেতাইভাবে ছবি নির্মাণ করে যাচ্ছেন; কেউ বছরের পর বছর পার করছেন। কথাগুলো বিএফডিসি পরিবার আর বাহিরের সঙ্কটকালের খণ্ডচিত্র মাত্র।

এরমাঝে পরিবারের বাইরের অনেকেই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করছেন। তাদের অর্জনে দেশও সমৃদ্ধ হচ্ছে বটে; কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে অবদমন ঠেকানো যাচ্ছে কই? 

দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ উঠেছে মধ্যসত্বভোগীদের কারণে প্রযোজকদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি। ফলে বাণিজ্যিক সিনেমার প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। স্বাধীন বা সৌখিন চলচ্চিত্র প্রযোজকরা এক বা দুইটি কম বাজেটের সিনেমা নির্মাণ দিয়ে কিছুদিন আলোচনায় থাকলেও পেশাদারিত্ব গড়ে উঠছে না। অভিযোগ উঠেছে সেন্সরবোর্ডের রক্ষণশীলতা নিয়েও। এ ব্যাপারটিতে মূলস্রোত বা স্বাধীন সকলেই ভুক্তভোগী। তাই দাবি উঠেছে নীতিমালা সংস্কারের, একই সঙ্গে যৌথপ্রযোজনার নীতিমালা সহজীকরণের। এ দাবিগুলো সর্বজনিন। পার্থক্য কেবল উপলব্ধির। দীর্ঘদিনের এই সঙ্কটপ্রশ্নে স্থবিরতা কাটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমা হলগুলো সংস্কার ও নতুন প্রকল্প গ্রহণে হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনাও ঘোষণা করেছেন। সে আলোকে কাজও চলমান। অবস্থা যখন এমন তখন সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ একত্রিত হয়েছেন যৌক্তিক কিছু প্রশ্নে; তবে চলচ্চিত্রের বৃহৎ পরিবারকে পাশ কাটিয়ে!

এখানে প্রাসঙ্গিতভাবে বলতে হয়- যারা একত্রিত হয়েছেন তাদের অধিকাংশের সঙ্গে সিনেমা দর্শকের বোঝাপড়াটা দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের মতো। দু-চারটি হল বা সিনেপ্লেক্স তাদের ভরসা। আবার তাদের সমর্থনে কলম হাতে দৌড়ঝাঁপ দেন করপোরেট বুদ্ধিজীবীরাও। এদের পাটভাঙা শাড়ির ভাঁজে দর্শকের রুচির ব্যাপারটায় মূলস্রোতের দর্শকের অংশগ্রহণ নেই। 

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে হঠাৎ কেন, কী উদ্দেশ্যে; তাদের এই নতুন ফোরমের ভাবনা? কারা রয়েছেন এর নেপথ্যে?

আহমেদ তেপান্তর : চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ