রবিবার ২০ এপ্রিল ২০২৫
১৪ ডিসেম্বর; এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ইতিহাস
অলোক আচার্য
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ৭:১৪ PM আপডেট: ১৩.১২.২০২২ ৭:২১ PM
কতকাল কেটে যায় কোনো দেশে একজন মেধাবী মানুষ জন্ম নিতে। একজন মানুষের হাত ধরে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে দেশ, একটি জাতি। কোনো গায়কের গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিকিৎসা, স্থাপত্য, নকশা, পরিকল্পনা দেশকে এগিয়ে নেয়। তাদের হাত ধরে মানুষের পরিশ্রমে দেশ গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্থান নামের দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পাকিস্থানের একটি অংশ ছিল তখনো পরাধীন। সেটা হলো পূর্ব পাকিস্তান। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্থানের একচেটিয়া মনোভাব, শোষণ ও নিপীড়ন, বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কোনোভাবেই পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের অধিকার মেনে নিতে পারেনি।

অধিকার থেকে ক্রমশই বঞ্চিত হওয়া বাঙালিরা তাদের এই বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি। চোখের সামনে ঘটে চলা এই বৈষম্য এদেশের মানুষের মনে স্বাধীন মনোভাবের জন্ম দেয়।  ফলে স্বাধীনতা শব্দটি ছিল বহু কাক্সিক্ষত। যার চূড়ান্ত রূপ পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো স্বাধীনতার ডাকে। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে পাকিস্থান সেনাবাহিনী ঘৃণ্য একটি ষড়যন্ত্র করে। এটি হলো বুদ্ধিজীবী নিধন ষড়যন্ত্র। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। মূলত ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। যার বাস্তবায়ন হয় ১৪ ডিসেম্বর। একটি নিকৃষ্ট পরিকল্পনা যা করা হয়েছিল দেশের অগ্রগতি স্লথ করার জন্য। যাদের হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাবে তাদের তালিকা করে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল।

যদিও যুদ্ধের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয়েছিল। দেশের স্বাধীনতায় যারা বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করছিল তাদের শুরু থেকেই হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে। ক্যাম্পে আটকে রেখে ভয়ংকর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাদের। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষিত সচেতন বাঙালিকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। এর কারণ মূলত একটিই। ওরা জানতো যে এই যুদ্ধে যারা শক্তি যোগাবে, যারা যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনা সাজাবে তারা এই শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। একটি দেশ সঠিক পথে পরিচালনার জন্য এবং সফলতার জন্য শ্রম এবং বুদ্ধি দুই-ই প্রয়োজন হয়। একটি দেশ উন্নয়নে শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, পরিল্পনাবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রেই দরকার দক্ষ ও সৃজনশীল ব্যক্তির। যাদের হাতের ছোঁয়ায় বদলে যায় সে দেশের সেই সব অঙ্গণ। বুদ্ধিজীবীরা হলেন মুক্তবুদ্ধির মানুষ যারা তাদের গবেষণা, চিন্তা-চেতনা দ্বারা সমাজের সমস্যাসমূহের সমাধান করেন। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় জাতি উপকৃত হয়। পরাধীনতার শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়ন মানুষের সামনে এনেছিলেন। 

দুই পাকিস্তানের বৈষম্যে সোচ্চার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। তারা সব সময় মানসিকভাবে শক্তি যুগিয়ে গেছেন। পরাজয়ের বার্তা যখন পাকিস্থান সেনাবাহিনী ভালোভাবেই টের পাচ্ছিল তখন তারা একটি স্বাধীন দেশকে পিছিয়ে দিতে দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। মূলত যখন তারা দেখলো সার্বিক পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না, পাকিস্থানের তৎকালীন মিত্র রাষ্ট্রগুলোও যখন পাকিস্থানকে আর সাহায্য করতে পারছিল না তখনই তারা ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্র করে। তারা দেশের খ্যাতনামা মানুষদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করতে আরম্ভ করে। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে এইসব বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শ এবং দিক নির্দেশনা একান্তভাবে প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের অগ্রগতিটা যেন শ্লথ হয় সে ব্যবস্থা তারা করতে চেয়েছিল। তারা নির্মমভাবে বেছে বেছে মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করে। এই লিস্ট তৈরিতেও পাকিস্থান বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এদেশের রাজাকাররা। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম কারিগর বুদ্ধিজীবীরা। তাদের চিন্তা-চেতনা সামনে এগিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বুদ্ধিজীবি হত্যার কারণে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও বহন করে চলেছে বাংলাদেশ। তারা বেঁচে থাকলে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক শৃঙ্খলা, গণতান্ত্রিক বিকাশ আরো মজবুত হতো, পূর্ণ হতো। সেদিন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সারের মতো মেধাবী মানুষদের ওরা হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সাময়িক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী। স্বাধীনতা লাভের পর গভর্নর হাউজে তার রেখে যাওয়া একটি ডায়েরি থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায়, যার অধিকাংশই নিহত হয় ১৪ ডিসেম্বর। অর্থাৎ একটি বিশেষ পরিকল্পনা, একেবারে শেষ মুহূর্তে। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু করা নির্মম হত্যাযজ্ঞের শেষ দিকে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটে। তারপর তাদের রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। কারো ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায় আবার কারো বা পাওয়া যায় না। যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি দেশের পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে সেই কঠিন কাজটিই করছিলেন। যদি এই মেধাবী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হতো। সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ আরো অগ্রসর হতো। কারণ এই বুদ্ধিজীবিরা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন একজন নক্ষত্র। তারা নতুন স্বাধীন দেশে যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে দেশটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত। এর ফলে আমাদের অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে।  

একটি সদ্য স্বাধীন জাতি এগিয়ে চলার জন্য প্রয়োজন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্থানীদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রথমেই ছিল বুদ্ধিজীবীরা। তাদের চোখে একটি স্বাধীন দেশ এবং সেই দেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। দেশকে দেওয়ার মতো ছিল অনেক কিছু। সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন কেন্দ্রে নির্মম নির্যাতন করা হতো, তারপর নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। বুদ্ধিজীবীরা এদেশের সূর্যসন্তান। তাদের ক্ষতি অপরিমেয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা যে কত সৌভাগ্যের তা কেবল স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, যে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। বহু জাতি বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ নয় মাস করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধুমাত্র দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে সাময়িকভাবে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে পারলেও বাস্তবিক পক্ষে আমরা আজ বহুদুর এগিয়েছি। কাউকে যে জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না তা আজ প্রমাণিত। পাকিস্থান নিজেরাই তাই আজ বাংলাদেশের উন্নতি দেখে অবাক। অবাক সারা বিশ্ব। সেই হারানো মানুষগুলো নেই ঠিক কিন্তু তাদের দেখানো তাদের স্বপ্ন দেখা পথ তো আছে। সে নিয়েই আমরা দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাবো। দেশের এই সূর্য সন্তানদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। 

অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। 
আজকালের খবর/আরইউ