মোবাইল ফোনের গেম শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাক্ষাৎ হুমকি হয়ে উঠছে। অনলাইন গেমে শিশুদের একাংশ এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে অভিভাবকরা বকাঝকা দেওয়ায় আত্মহত্যাও করেছে এক শিশু। এক কিশোরকে বাবা-মা মোবাইল ফোনের গেম খেলতে নিষেধ করায় সে বাড়ি ছেড়ে পাঁচ মাস ধরে ছিল আত্মগোপনে। ফেসবুকে বন্ধুত্বের ফাঁদ পেতে র্যাব সদস্যরা তার অবস্থান শনাক্ত করে। কিশোরটিকে উদ্ধার করে অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। র্যাব সদস্যদের মতে, পাবজিসহ বিভিন্ন গেম ও নিষিদ্ধ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছিল সেই কিশোর। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর এজন্য বাবা-মা শাসন করলে অভিমান করে মোবাইল ফোন রেখে বাসা থেকে পালিয়ে যায়।
স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় সহজেই পর্নো ভিডিওসহ অশ্লীল ও অনৈতিক ভিডিও দেখার সুযোগ অনায়াসেই পেয়ে যায় অপরিণত বয়সীরা। আর এসব শিশু-কিশোরই একটু বড় হলে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে। দলবেঁধে আড্ডা দেওয়া, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, মেয়েদের উত্তক্ত করাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা।
মোবাইল ফোনের অপপ্রয়োগে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে এমনকি শিক্ষার্থীরা বখাটেপনায় জড়াচ্ছে। মোবাইল ফোনে গেম খেলতে গিয়ে তারা সন্ত্রাসীদের কিছু ভাষা বা অপরাধীদের ভাষা মনের অজান্তে মস্তিষ্কে ধারণ করছে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করছে। এভাবেই ধীরে ধীরে বখাটেপনা ও অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। মোবাইল ফোন আসক্ত উঠতি বয়সীরা আসক্তির চরম পর্যায়ে মোবাইল ফোনের এমবি/টাকা যোগাতে পরিবার ও নিকটজনদের থেকে টাকা বা মূল্যবান জিনিস চুরি করতেও পিছপা হচ্ছে না।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দমবন্ধ পরিবেশে গত দেড় বছরে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। এ সময়ে ৭০ শতাংশ শিশুই শারীরিক কোনো কাজ বা খেলাধুলার সুযোগ পায়নি। এতে বেড়েছে মানসিক নানা রোগ। গবেষণায় উঠে এসেছে, ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীই মোবাইল ফোনে আসক্ত। এ ছাড়া দিনের অধিকাংশ সময় নয় ভাগ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে আর আট ভাগ শিক্ষার্থী ট্যাবে সময় ব্যয় করে। এই আসক্তির মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী তা ব্যবহার করেছে অনলাইন ক্লাসের জন্য। আর ৪০ ভাগ কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে, ২৭ ভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার এবং ১৭ ভাগ আসক্ত বিভিন্ন গেমসে। গেল বছর ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই খেলাধুলার অবকাশ পায়নি। এরমধ্যে ৫০ শতাংশই বের হতে পারেনি বাইরে।
স্বাস্থ্যগত ভয়াবহ ক্ষতির দিকটিও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। তাতে, দেখা যায় আগে যেখানে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়ার মতো রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হতো শিক্ষার্থীরা, গত দেড় বছরে মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতা ও খিটখিটে মেজাজের মতো ব্যাধি দেখা যাচ্ছে বেশি।
দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ তাদের স্মার্টফোনের ওপর এতোটাই নির্ভরশীল যে এটি আসক্তির মতো হয়ে গেছে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ আসক্তিমূলক আচরণের অর্থ তারা যদি মোবাইল ফোন সবসময়ের জন্য হাতে না পায় তাহলে তারা ‘আতঙ্কিত’ বা ‘বিচলিত’ হয়ে পড়ে। এই তরুণরা মোবাইল ফোনের পেছনে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে তারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ ধরনের আসক্তিমূলক আচরণ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে, যেমন স্ট্রেস বা শারীরিক ও মানসিক চাপ, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের অভাব এবং স্কুলের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়া।
শিশু এবং তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে এবং শিশুরা ফোনে কতটা সময় ব্যয় করছে অভিভাবকদের তা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। স্মার্টফোনের প্রভাব সব সময় একমুখী হয় না। ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মন-মেজাজ স্মার্টফোন ব্যবহারের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে। স্মার্টফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, সেইসঙ্গে শারীরিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ না পাওয়া, এ দুই মিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্যাটি যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই তা আশঙ্কার একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মোবাইল ফোন গেম এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে অতিরিক্ত গেম আসক্তিতে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা পাচ্ছে মানসিক বিকাশ। এ কারণে ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের চোখ ও মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেখা যাচ্ছে। অনলাইন গেমিং আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মোবাইল গেমের কারণে শিশুরা লেখাপড়া-বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের ব্যক্তিত্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ ধরনের শিশুর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুুঁকি বেড়ে যায়। একটানা দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় অনলাইন গেমে শিশুরা ক্ষীণদৃষ্টি বা ‘মায়োপিয়া’য় আক্রান্ত হচ্ছে। চক্ষু হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা শিশুর মধ্যে ৮০ শতাংশ এ সমস্যায় ভুগছে। শিশুরা মোবাইল ফোনের গেমে এতই আসক্ত যে তাদের খাওয়ার সময় মোবাইল ফোন না দিলে খেতে চায় না, অতিরিক্ত জেদ দেখায়, সহিংস আচরণ ও কান্নাকাটি করে। মোবাইল আসক্তি থেকে শিশুদের রক্ষায় মা-বাবাদের সচেতন হতে হবে সবার আগে। তাদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার অবিমৃশ্যকারিতা থেকে দূরে থাকতে হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
আজকালের খবর/আরইউ