সোমবার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বুড়িগঙ্গা; সেকাল, একাল এবং আগামীকাল
আল-মামুন
প্রকাশ: সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৮:২০ পিএম
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশকে ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একসময় এই নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল দেশের অর্থনীতি। নদ-নদীই ছিল জীবন ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। তাই তো বাংলার সাহিত্য-কবিতায় নদ-নদীর রয়েছে এক অপার মহিমান্বিত অবস্থান। কিন্তু যন্ত্রচালিত শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরাই তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছি নদীগুলোকে। তেমনি মানুষের নির্মমতার এক জলন্ত উদাহরণ বুড়িগঙ্গা। 

বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। বলা হয়ে থাকে টেমসের তীরে যেমন লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট, তেমনই বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা। ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নদী গঙ্গা বা পদ্মার পুরোনো প্রবাহপথ। আর এটি ধলেশ্বরীর একটি শাখা। পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে স্রোতধারা অনেক দক্ষিণে সরে গেলে পরিত্যক্ত ক্ষীণ ধারাটি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। অতীত ইতিহাস বলে, এটি ছিল জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত একটি নদী। এই নদীটির জোয়ার-ভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিলেন মোগলরা। 

অনেকেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার। বুড়িগঙ্গার এই রূপ স্থায়ীভাবে উপভোগ করতে মোগলরা চলে আসেন ঢাকায়। ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে স্থাপন করেন ঢাকা নগরী। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ নগরীকে আরেকটু রাঙিয়ে দিতে রাতে নদীর তীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোগল সুবেদার মুকাররম খাঁ। আবার বর্ষাকালে এই নদীতীরের জনপদকে জলমগ্ন ভেনিস নগরীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন অনেক ইউরোপিয়ান বণিক। এমনকি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও বুড়িগঙ্গার সচ্ছ পানি ঢাকার সেই আদি জনপদকে বিনা মূল্যেই ভেনিস দেখার ব্যবস্থা করে দিত। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা টইটম্বুর জল উপচে পড়া বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লিখেছেন কবিতা। বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন- সমালয় সন্নিহিত/ বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত/বন্দাঘাট শোভিত যাহাতে/সেখানে বসিয়ে গিয়ে/জুড়ায়া সন্তপ্ত হিয়া/সলিল শিকারসিক্ত রাতে।

বুড়িগঙ্গা নিয়ে এরকম অনেক কথাই শুনেছি। কিন্তু প্রথমবার যখন বুড়িগঙ্গা দেখতে গেলাম তখন থমকে দাঁড়ালাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ভুল জায়গায় এলাম না তো! পরক্ষণেই জেনেছি, এটাই আমাদের বুড়িগঙ্গা। ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। তখন থেকে মনের ক্যানভাসে কেবলই বুড়িগঙ্গার ছবি ভেসে উঠত। না জানি বুড়িগঙ্গা দেখতে কত সুন্দর! বইয়ের পাতায় দেখা বুড়িগঙ্গায় নদীর স্বচ্ছ জলে ছিল সারি সারি নৌকা। মাঝি গলা ছেড়ে গান গাইছে ‘মাঝি বাইয়া যাও রে...’।  কল্পনার সেই বুড়িগঙ্গার সঙ্গে বর্তমানের বুড়িগঙ্গাকে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। যে আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে বুড়িগঙ্গার রূপ দর্শন করতে গেলাম, তার জীর্ণশীর্ণ, শ্রীহীন, দূষিত, দুর্গন্ধময় চেহারা দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যথিত হলাম। বুড়িগঙ্গার আগের রূপ বা সৌন্দর্য এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।

পৃথিবীর ইতিহাস বলে সর্বত্রই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকূলকে কেন্দ্র করে। নদী মানুষকে সভ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। এসব নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো জনপদ। তেমনি নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নগরী ঢাকা। মোগল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার বয়সও ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ এই নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য সবগুলোর শেষ ঠিকানা এই বুড়িগঙ্গা। প্রতিনিয়ত প্রায় তিন কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকা মহানগর ও কেরাণীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যরে প্রতিটি ফোঁটা এই নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করেছে। কালো রঙের পানি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা। এর সঙ্গে বিশ শতকের নতুন আবিষ্কার পলিথিন দূষণের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে। নদীর এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী ঢাকা নগরীর মানুষ। 
 
আগেকার দিনে মানুষ একটু প্রশান্তির জন্য বুড়িগঙ্গায় বেড়াতে যেত। নৌকা করে পাড়ি দিত এপার-ওপার। এসময় নদীর জল দু’হাতে ভরে ছুড়ে দিত আকাশের দিকে, গায়ে মাখত। বালকেরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ত নদীর জলে। আর শঙ্খচিলের দল ডালা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াত। মাছরাঙাটি ছোঁ মেরে লুফে নিত তার শিকার। মাঝি-মল্লার মুখে ফুটে উঠত গান। জেলেদের মুখে ফুটত হাসি। কী সুন্দরই না ছিল সেসব দৃশ্য!  কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নয়, পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের যত ধরনের সূচক আছে, সব ধরনের সূচকেই বুড়িগঙ্গার পানি জলজ প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী। এই বিষাক্ত পদার্থ আর ভারি ধাতুর অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এই নদীতে। শুধু তাই নয় বুড়িগঙ্গার পরিবেশ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। 

বুড়িগঙ্গার আজকের এই করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। এই অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে সৃষ্টি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। যার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এবং উঠছে বিভিন্ন ধরণের শিল্প-কারখানা। অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বুড়িগঙ্গার পরিবেশকে দিনকে দিন দূষিত করেছে। ঢাকা শহরের মানুষের সব বর্জ্য ফেলা হয় এই নদীতে। শহরের ড্রেনগুলোর সাথে যেন এই নদীর আছে এক আন্তঃসম্পর্ক। যার ফলে ড্রেনের মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে এসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আবার বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ ও যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রচুর পরিমাণ নৌযান নদীতে চলাচলের কারণে নৌযানের পোড়া মবিলও বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। আর এসব কারণেই বুড়িগঙ্গা আজ হুমকির মুখে। কবিগুরু আজ বেঁচে থাকলে বুড়িগঙ্গার এই করুণদশা দেখে ব্যথিত হতেন। মনের ক্ষোভে ও দুঃখে হয়তো আরেকটি কবিতা লিখতেন।

যে নদীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প-কারখানা, তার ওপর যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখলদারিত্ব। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা এখন নাজুক। নদী হয়ে গেছে সংকুচিত। আর যেটুকুই-বা আছে তা ভরে আছে সব বিষাক্ত পদার্থে। এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকার অন্য নদীগুলোর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ সারা বছর নাব্য রাখার। নদীতীর দখলমুক্ত করে জনসাধারণের জন্য হাঁটা-চলার রাস্তা তৈরির সঙ্গে লাগানো যায় দেশীয় প্রজাতির গাছ। সরকারের সদিচ্ছা ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে দীর্ঘমেয়াদে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দিন দিন ইট-পাথরের জঙ্গল হয়ে ওঠা ঢাকাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে বুড়িগঙ্গার হারানো রূপ পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। নতুবা অতীতের সৌন্দর্য শোভিত যে বুড়িগঙ্গা আজ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, সেই বুড়িগঙ্গাকে অনাগত প্রজন্ম খুঁজে ফিরবে। তারা এই নদীকে খুঁজে পাবে সাহিত্য, গান কিংবা কবিতায়, বাস্তবে নয়। তবু আমার লেখক মনে আশা জাগে, আবারো এই বুড়িগঙ্গায় দেখা দিবে জোয়ার-ভাটা, জীবকুল ফিরে পাবে প্রাণ, মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে করবে খেলা, মাছরাঙাটি ওত পেতে বসে থাকবে শিকারের আশায়, জেলেদের মুখে ফুটবে হাসি, মাঝি-মাল্লার মুখে ফুটে উঠবে গান, শঙ্খচিলের দল ডানা মেলে উড়বে স্বাধীনভাবে, ক্লান্ত বিকেলে বালকেরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়বে নদীর জলে, সবুজে-সবুজে ভরে উঠবে নদীর দুই তীর, আর কবি-সাহিত্যিকদের কলম হয়ে উঠবে অস্ত্রের থেকেও ধারালো। সেই বুড়িগঙ্গাকে দেখতে পারবো কিনা জানি না! 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
নান্দাইল পৌর সদরে এক রাতে তিন বাসায় চুরি
শিক্ষাবিদ নূরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের ইন্তেকাল
নতুন বছরে জঙ্গি মোকাবিলায় প্রস্তুত র‌্যাব: ডিজি
বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন মারা গেছেন
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা গান
এভাবে চলে যেতে নেই
পরীমনির জীবনটা আমার জীবনের মতো: তসলিমা
কেউ আক্রমণ করলে ছাড় দেবো না: কাদের
২০২৩ হোক অগ্রযাত্রার আরেকটি বছর: সজীব ওয়াজেদ জয়
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft