
দেশের বৃহত্তম সিনেমা হল যশোরের মণিহার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এক সময় মণিহার এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম একক পর্দা সিনেমা হল ছিল। হলটি ভেঙে সেখানে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা হবে। ছবির অভাব ও ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে হল কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথচ এক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন- ‘ইট-পাথর ভাঙলেও ভাঙবে না মণিহারের আলো’।
জানা গেছে, ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় মণিহার সিনেমা হল। এই হলটি তার আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য পরিচিত ছিল। এখন এটি ‘মণিহার সিনেপ্লেক্স’ নামে আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটারে রূপান্তরিত হয়। যেখানে যুক্ত করা হয় নতুন ৬৬ আসনের ছোট থিয়েটার। ৪২ বছর আগে তৈরি হওয়া এই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলটি এবার ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হলটি ভেঙে সেখানে মার্কেটের বর্ধিতাংশ হিসেবে আবাসিক হোটেল তৈরি করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিনেমা হলটির মালিক জিয়াউল ইসলাম মিঠু। গেল ঈদের পর বেশ মন্দা সময় পার করছেন বলে জানা গেছে। সিনেমা না থাকায় এখন হলটিতে কলকাতার সিনেমা চালাচ্ছেন তারা। তাতেও দর্শক মিলছে না। এ ছাড়া সিঙ্গেল হলটি ছাড়াও একটি মাল্টিপ্লেক্স হল ‘মণিহার সিনেপ্লেক্স’ থাকায় সেটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
হলটির মালিক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, “এখন তো ছবি নেই, ছবি না থাকলে হল কিভাবে চালাব? এখন কলকাতার ‘অভিমান’ সিনেমাটি চালাচ্ছি, যেটা এর আগে চারবার চালিয়েছি। আর সিনেপ্লেক্সে চালাচ্ছি সালমান শাহের ‘বিক্ষোভ’ সিনেমাটি। এভাবে তো চালানো যায় না। তাই আমরা পরিকল্পনা করছি হলটি বন্ধ করে দেওয়ার। লোকসানের পাল্লা ভারী হতে হতে এখন হলের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
হলটি ভেঙে মার্কেট করা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের হলের সিট সংখ্যা ১৪৩০টি। স্টাফ আছে ২৫ জন। এভাবে তো চালানো যায় না। দেখা যায় পুরো মার্কেটে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে এক-দেড় লাখ টাকা। সিঙ্গেল হলটি ভেঙে হয়তো সামনে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল করব। তা ছাড়া আরেকটা সিনেপ্লেক্সও হতে পারে। ইতোমধ্যে আর্কিটেকচারকে ডিজাইন করতে দেওয়া হয়েছে, এরপর সেটা পাস করে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হবে। এটাও সময় লাগবে সব কিছু হতে। তার আগ পর্যন্ত হয়তো আমরা এভাবেই চলাব।
কবে নাগাদ এই সিঙ্গেল হলটি ভেঙে ফেলা হবে, সেটি এখন নিশ্চিত করতে না পারলেও জানালেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছে, সেগুলো পাস হলে তারপর হয়তো ভাঙনের কাজ শুরু হবে। এ সময় দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। সিঙ্গেল হলটি ভাঙা হলেও সিনেপ্লেক্সটি সচল থাকবে বলে জানালেন এই হল মালিক।
যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সাজেদ রহমান বকুল ফেসবুকে লিখেছেন- আশির দশকের শুরু। খুলনা রেডিওতে ভেসে আসত এক বিজ্ঞাপন “এখন মণিহারে চলছে...”। তখনই বুকের ভেতর কেমন যেন ঢেউ খেলে যেত। অপেক্ষা করতাম, কখন নামটা শুনব, কোন ছবি চলছে। সেই বিজ্ঞাপন শুনতে শুনতেই বড় হয়ে উঠেছিল এক প্রজন্ম।
১৯৮৩ সালে সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত ‘জনি’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মণিহারের। দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রেক্ষাগৃহে ১ হাজার ৪৩০ জন একসঙ্গে বসে দেখতেন রঙিন স্বপ্ন। দিনে চারটি শোতেই থাকত দর্শকের ঢল। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যেন উৎসবমুখর ছিল মণিহারের প্রতিটি দিন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে সবকিছু। দর্শক কমেছে, সিনেমার মান কমেছে। মাল্টিপ্লেক্স করেও আর ফিরিয়ে আনা যায়নি সেই সোনালি দিন। আজ মালিকপক্ষ বলছে, লোকসানের বোঝা আর টানা যাচ্ছে না। মণিহার ভেঙে ফেলতে হবে। যদিও নতুন মার্কেটের ভেতর রাখা হবে মণিহার সিনেপ্লেক্স।
তবু, যারা কৈশোরের প্রেম লুকিয়ে, বন্ধুদের হাত ধরে কিংবা পরিবারের সঙ্গে একসময় গিয়েছিলেন মণিহারে তাদের মনে এই নাম কখনও ভাঙবে না। “ইট-পাথর ভাঙলেও ভাঙবে না মণিহারের আলো।”
উল্লেখ্য, এক সময় সিনেমা হলে সিনেমা দেখার জন্য জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা আসতেন।
আজকালের খবর/ওআর