মঙ্গলবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
তলাবিহীন ঝুড়ি ইবির আবাসিক হল, ২ লক্ষ ৮৫ হাজার কার ঘাড়ে?
রবিউল আলম, ইবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৬:১৯ পিএম
বিগত আওয়ামী শাসনামলে অবহেলিত হল নামে পরিচিত ছিলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শহীদ জিয়াউর রহমান হল। নামের কারণে আবাসিক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন বলেও ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। 

শিক্ষার্থীদের আবাসিক, ভর্তি  ও অন্যান্য খাত থেকে নির্ধারিত ফি নিয়মিত আদায় করে আসলেও যৌক্তিক লিখিত হিসাব দেখাতে পারেননি হল প্রশাসন। বিগত ১৬ বছর হিসাববিহীন দায়িত্ব হস্তান্তর হয়েছে বলে জানান হল-দপ্তর কর্মকর্তারা। আয়-ব্যয় হিসাব না থাকায় হল ফান্ডের বিষয়টাও দীর্ঘদিন ধরে অগোচরে থেকে গেছে। প্রভোস্ট এক আসে এক যায়, ফান্ড শূন্য থেকে যায়। এ যেন এক তলাবিহীন ঝুড়ি। তবে বর্তমান প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল গফুর গাজী দায়িত্ব গ্রহণের পর নড়েচড়ে বসেছে হল বডি।

এদিকে ওই হলের সাবেক প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শেখ এ. বি. এম. জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে হলের আয়-ব্যয় হিসাব বাবদ ২ লক্ষ ৮৫ হাজার ৪ শত ৯৯ টাকা বকেয়া রেখে পরিশোধ না করার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ১ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকার হিসেব পান পাননি বর্তমান প্রভোস্ট। তবে অভিযুক্ত সাবেক প্রভোস্টের দাবি— সব হিসাব দিয়েছেন তিনি। যদিও তার ভাষ্যমতে এক প্রভোস্ট অন্য প্রভোস্টকে হিসাব দেওয়ার নিয়ম নাই। হিসাব দেখতে পারে অর্থমন্ত্রণালয়ের অডিট। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন— বকেয়া টাকাটা কার ঘাড়ে?

জানা যায়, গত ২০২৩ সালের ১৫ মে আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ এ.বি.এম. জাকির হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম হল প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। পরপর ২ বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত ১৪ মে দায়িত্ব ছেড়ে দেন তিনি। কিন্তু ২ বছরের হিসাব-নিকাশে গরমিল দেখা দিয়েছে। 

দায়িত্ব পালনকালে পূর্বের স্থিতিসহ মোট ৪৫,৮৪,৭০৪ (পঁয়তাল্লিশ লক্ষ চুরাশি হাজার সাতশত চার টাকা) আয় হয়। উক্ত সময়কালীন মোট ব্যয় হয় ৪৫,৮৩,৩২৩ (পঁয়তাল্লিশ লক্ষ তেজাশি হাজার তিনশত তেইশ টাকা) এবং ব্যাংকে স্থিতি ছিল ১,৪৮১ (এক হাজার চারশত একাশি টাকা উনত্রিশ পয়সা) মাত্র। অত্র হলের সংরক্ষিত ক্যাশ বই ও বিল ভাউচার অনুযায়ী তার সময়কালীন মোট ৪৪,১৪,৮০৯ (চুয়াল্লিশ লক্ষ চৌদ্দ হাজার আটশত ঊনসত্তর) টাকার ব্যয়ের হিসাব পাওয়া গিয়েছে। এতে ১ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকার হিসেব পাওয়া যায়নি। 

এদিকে ওয়াইফাই বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার পরিশোধ না করা ও চেয়ার টেবিল বাবদ ৪৬ হাজার, আবাসিক এক সিটে ২/৩ জন করে বরাদ্দ দেয়া সহ নানা অভিযোগ উঠেছে সাবেক প্রভোস্টের বিরুদ্ধে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে বলে জানান বর্তমান হল কর্তৃপক্ষ ও আবাসিক শিক্ষার্থীরা। 

হল সূত্রে জানা যায়, শহীদ জিয়াউর রহমান হলে রয়েছে মোট ৪০০ আবাসিক সিট। বর্তমান ৩৮০ সিটে বৈধপন্থায় অবস্থান নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০২৩ সালের আগে আওয়ামী শাসনামলে মাত্র ৬৩ টি সিটে বৈধভাবে অবস্থান নিতো শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে সাবেক প্রভোস্ট দায়িত্ব পালনকালে ৪০০ সিটে শিক্ষার্থী অবস্থান নিলেও কার্যত লিখিত ডকুমেন্টস ছিল না। ছাত্রলীগের সাথে বাধ্য হয়ে লেয়াজু করে হল চালানো লাগতো বলে জানা যায়। যার ফলে অবৈধ সিটে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হলে থাকার সুযোগ ছিল। যার কারণে গত ১৬ বছরের হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানান হল কর্মকর্তা। 

জিয়া হলের কর্মকর্তার মধ্যে একমাত্র দায়িত্বে আছেন মো. মিজানুর রহমান। এর আগে একই সাথে কাজ করতেন মো. ওয়াজেদ মিয়া, তারেক ও জুবায়ের। তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে আর্থিক কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় মো. ওয়াজেদ মিয়াকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থগারে বদলি করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বর্তমান দায়িত্বে থাকা হল কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানের কাছে ১৬ বছরের লিখিত হিসাব দেখতে চাইলে তিনি জানান, ‘ছাত্রলীগের আমলে জানের ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না; হিসাব তো দূরের কথা। আগে ৬৩ সিট বৈধ ছিল, জাকির (সাবেক প্রভোস্ট) স্যার আসার পর সবাইকে বৈধ সিটের আওতায় আনার চেষ্টা করেছে।’

হল থেকে বদলি হওয়া ওয়াজেদ মিয়ার কাছ থেকে হিসাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি সবার ছোট ছিলাম, মিজান, তারেক ও জুবায়ের করছে। তাদের থেকে নিয়মকানুন পাইনি। বর্তমান কর্মকর্তা হিসেব দিতে পারবে।’

এদিকে বিপুল নামের একজন ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি ওই স্যারের (ড. জাকির হোসেন) কাছে বারবার গিয়েছি। কোনো মতে কিছু আদায় করছি। আরও ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পাব। বর্তমান প্রভোস্টকে বললে আগের প্রভোস্টকে দেখিয়ে দেয়। অপেক্ষা করতে বলে কিন্তু এই টাকা আমি কার কাছে চাইব?’

আরেক টেকনিশিয়ান ও আবাসিক শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘জিয়া হলে ওয়াইফাই সংক্রান্ত চুক্তিভিত্তিক কাজ করে আসছিলাম। মাসিক একটা পে-মেন্ট হিসেবে ২ হাজার করে দেওয়ার কথা কিন্তু এক মাসের টাকা পরিশোধ করলেও ৫-৬ মাস বকেয়া পরিশোধ করেনি। পরে শুনলাম আরেকজন টেকনিশিয়ান রাখছে জাকির স্যার।’

আবাসিক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ— অন্যান্য হলের মতো সকল ধরনের ফি জমা দিয়ে আবাসিকতা নেওয়া হয়। কেন যেন আগের মতোই সব চলছে। বিপ্লব পরবর্তী হল সংস্কার হবে বলে আসা করছিলাম। কিন্তু অন্য হলের রিডিং রুম, ওয়াশরুম, ডাইনিং-এর খাবার মান, এসি সুবিধা পেলেও আমারা সব থেকে বঞ্চিত। শুধু প্রভোস্ট বদল করে কিন্তু সিস্টেম একই থাকে। বর্তমান প্রভোস্টের কাছ থেকে পজিটিভ কিছু আশা করছিলাম। ওনি চেষ্টা করলেও ফান্ডের দোহাই দেয়।

শহীদ জিয়াউর রহমান হল যেকারণে বঞ্চিত উল্লেখ করতে গিয়ে হল কর্মকর্তা জানান, শহীদ জিয়াউর রহমানের নামে হলের নামকরণ, নিয়ম ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করে হল প্রভোস্ট সিন্ডিকেট সদস্য হতে পারেনি। অথচ চক্রাকারে জিয়া হল সদস্য হওয়ার কথা। এছাড়া সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক দেয়া ভর্তুকিও অন্য হলের তুলনায় কম দেয়া হয়েছে।

বর্তমান প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল গফুর গাজী বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের ওয়াদা করে দায়িত্ব নিয়েছি। সেই ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিদ্ধ। সাবেক প্রভোস্টের কাছ থেকে অনেকদিন থেকে হিসাব চেয়েছি। কিন্তু গড়িমসি করায় ৪ মাস পর হাতে এসেছে। তাও কিছু গরমিল ও বকেয়া রেখে গেছে। আমি লিখিত হিসাব ভিসি স্যার বরাবর সাবমিট করবো। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রভোস্ট ড. জাকির হোসেন বলেন, ‘একজন প্রভোস্টের হিসাব অন্য প্রভোস্ট চাইতে পারে না। অর্থমন্ত্রণালয় অডিট করতে পারে এবং ইতোমধ্যে অডিট করেছে। মন্ত্রণলায় সিদ্ধান্ত নিবেন। সব ফাইল হল অফিসারের নিকট দিয়েছি।’

ওয়াই-ফাই খরচের ব্যাপারে তিনি জানান, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করেছি, সুতরাং বর্তমান হল প্রভোস্ট দেখবেন। আমি তো এখন দায়িত্বে নাই।’

এক সিটে একাধিক শিক্ষার্থীকে অ্যালটমেন্ট দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘শেষ মুহূর্তে এসে ১২ টা সিটে অ্যালটমেন্ট ছিল না, বারবার নোটিশ পাঠানোর পরেও তারা অবৈধভাবে অবস্থান করছিলেন, যখন ওই সিটে অ্যালটমেন্ট দিলাম তখন সাথে সাথে আগে থেকে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা টাকা জমা দিয়েছে। যার কারণে ঝামেলাটা সৃষ্টি হয়েছে।’

আর্থিক গরমিলের ব্যাপারে তিনি জানান, ‘যারা হলের স্টাফ ছিল তারা বিভিন্ন ভাবে কারণ দেখিয়ে নোট আনতো, আমি সিগনেচার করতাম। কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছু অনিয়ম পাওয়ায় তাৎক্ষণিক হল থেকে সরানো হয়েছিল। দীর্ঘদিনের হিসাব হলের কর্মকর্তারাই দিতে পারবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হচ্ছে, একজন দায়িত্ব শেষ করে সবকিছু পরবর্তী দায়িত্বশীলকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন। জিয়া হল অডিট করছে এমন নথি ফাইল পাইনি। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি।’ 

উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে হিসেব দেয়া-নেয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করেননি। অনিয়মের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ৪ মাস হয়ে গেছে, এতদিন হিসাব না নিয়ে বর্তমান প্রভোস্ট কাজ করবে কেন। হল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্তমান হল প্রভোস্ট দেখবে এমন তো নিয়ম।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘হিসাব তো চাইতে পারে। মন্ত্রণালয়ের বিষয়টা ঢাহা মিথ্যা কথা। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান হল নিয়ে কনসার্ন। খতিয়ে দেখা হবে।’

আজকালের খবর/ওআর











http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের জানাজায় মানুষের ঢল
যেকোনো সময় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সচল করা হতে পারে: ড. ইউনূস
নির্বাচন ঘিরে অনেকেই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে: আইজিপি
জেন-জি বিক্ষোভের মুখে সরকার ভেঙে দিলেন মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট
যারাই ষড়যন্ত্র করবে জনগণ তাদের প্রতিহত করবে: সালাহউদ্দিন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
তলাবিহীন ঝুড়ি ইবির আবাসিক হল, ২ লক্ষ ৮৫ হাজার কার ঘাড়ে?
নয়াদিল্লির ৩ শতাধিক স্কুলে বোমা হামলার হুমকি
সোনাতলায় ইউএনও ও ওসির পূজামণ্ডপ পরিদর্শন
প্রতিবেশী দেশ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের ইন্ধনে খাগড়াছড়িতে অস্থিরতা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
পাহাড়ে পুরাতন খেলা শুরু হয়ে গেছে: হাফিজ উদ্দিন
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft