সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সমাজের দর্পণ এবং দেশের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। একটা সময় সাংবাদিকতার সম্মান, খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। নীতি-নৈতিকতা ও মনোভাব ছিল সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করা। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। একটি বাইক, একটি মোবাইল ফোন থাকলেই হওয়া যায় সাংবাদিক। আবার এই পেশায় আসতে না লাগে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা, না লাগে কোনো অভিজ্ঞতা। ৫০০-১০০০ টাকা হলেই বনে যাওয়া যায় মস্ত বড় সাংবাদিক। বর্তমানে জ্ঞানী, কর্মট, দক্ষ, পড়াশোনায় ভালো এমন লোককে এই পেশায় খুব কম দেখা যায়। হকার, বাটপার, চিটার, আন্ডার মেট্রিক, ধূর্ত লোকদের দখলে বর্তমানের এই পেশা সাংবাদিকতা। দুই-চারজন ভালোমানের সাংবাদিক থাকলেও কার্ডধারীদের দখলে তাদের সম্মান ও যায় যায় প্রায়। এসব সমস্যার জন্য দায় অবশ্যই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকবৃন্দ এবং পত্রিকা হাউস বা পত্রিকা অফিসগুলোর। কারণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নবীনদের সুযোগ দিতে চায় না। অবহেলা করে ছুড়ে ফেলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়।
আবার পত্রিকার মালিক হওয়া এখন বেশ সস্তা এবং অতিসহজ কাজ। কোনো রকমে একটি ওয়েবসাইট খুলে বনে যাওয়া যায় সম্পাদক। লিখতে পারা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো ব্যপার না। পাঁচশ বা এক হাজার টাকা দিলেই সাংবাদিক হওয়া যায় কার্ড পাওয়া যায় কুরিয়ারে। এসব কার্ডধারি সাংবাদিকদের আনাগোনা এবং চাল-চলন দেখলে মনে হয় এরাই মস্ত বড় সাংবাদিক। এসব নীতি-নৈতিকতাহীন সাংবাদিকরা দুই-তিন জন মিলে একটি প্রেস লেখা স্টিকার গাড়িতে হাকিয়ে চড়ে চষে বেড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ-বিদ্যালয়, ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়, মাটি কাটা, বালু উত্তোলনের ঘাঁটি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া মিটিয়ে দুই পক্ষ থেকে কিছু টাকা আদায় করে নিজের পকেট ভারী করে। এসবই যে এদের ধান্দা। এসব নামধারী সাংবাদিকদের কাছ থেকে পার পায় না রাস্তার পাশে দোকান করা বিধবা মা- বাবারাও। শুধু তাই নয়! ঈদ আসার সাথে সাথেই এদের দৌরাত্ম্য ও ছোটাছুটি বেড়ে যায়। সরকারি অফিসে ভিক্ষা নেওয়ার জন্য। কোনো অফিসে গিয়ে চা বা দুপুরের খাবার অথবা ইফতার করার জন্য টাকা দাবী করে। তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়, ভিক্ষুকের চেয়ে একটু বেশি। একশো থেকে শুরু করে দু’শ বা তিনশ যা দিবেন তাতেই খুশী তারা। এদেরকে সমাজের লোক সাংঘাতিক হিসেবেই আখ্যা দেয়।
মফস্বলে বা জেলা উপজেলা শহরে যারা সাংবাদিকতা করে তাদের অবস্থা বেশ ভয়ানক। জেলা-উপজেলাগুলাতে প্রেসক্লাব ডজন খানেক করে এবং সাংবাদিকদের গ্রুপিং চোখে পড়ার মতো। যে যার মতো ইচ্ছা একটি করে প্রেস ক্লাব খুলে বসে আছে। মূল ধারার সাংবাদিকতার অন্তরায় এসব কার্যকালাপ।
মফস্বলের সাংবাদিকতার অন্যতম আরেকটি চ্যালেঞ্জ বিনা বিতনে কাজ করা। জেলা পর্যায়ে কিছু পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল বেতন দিলেও অধিকাংশ মিডিয়া হাউজগুলো উপজেলা প্রতিনিধিদের একটাকাও বেতন দেন না। বরং সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে অপ-সাংবাদিকতা শেখায়। আবার আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের চাপ। সংবাদকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞাপনকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। এতসব সমস্যার অন্তরালেও সাংবাদিকতা একটি নেশা। আর নেশার কারণেই অনেকে নিজের কামানো টাকা খরচ করে আজ অবদি এই পেশায় কাজ করে যাচ্ছেন।
মফস্বলে সাংবাদিকতার খুব একটা মজা নেই। আত্মীয়-স্বজন, প্রভাবশালী সাংবাদিক এবং পরিচিত মানুষের কারণে সঠিক সংবাদ পরিবেশেন করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যপার। একটি সংবাদ কারো পক্ষে গেলে তিনি সাংবাদিকের সুনাম করবেন আবার সংবাদ বিপক্ষে গেলে তিনি সাংবাদিককে শত্রু ভাবতে শুরু করেন। নানাভাবে হুমকি ধামকি প্রদর্শন করেন। আবার কারোর বিপক্ষে সংবাদ গেলে তিনি সাংবাদিককের বাড়িতে অথবা এই সাংবাদিকের সাথে যার সম্পর্ক ভালো অথবা যাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করে তাকে জানিয়ে সংবাদ বন্ধ করার পায়তারা শুরু করে। এদিক থেকে নবীন সাংবাদিকরা পরে বেকায়দায়! যা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে একজন মফস্বলের সাংবাদিক! রাজনৈতিক সংবাদ করা মফস্বলের সাংবাদিকদের জন্য আরো বেশি ঝুকিপূর্ণ। কারণ যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে সেই দল বা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন হলে তারা মামলা-হামলা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশে বাঁধা প্রদান করে। তবে কিছু সাংবাদিক আবার সবসময় ভাল ভাবে চলতে-ফিরতে পারে। কারণ তারা সর্বদলীয়। এসব সাংবাদিকদের কাজই হচ্ছে তেল মেরে বা পা-চেটে শক্তিশালি গ্রুপের পক্ষ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে নানা ধরনের সুবিধা গ্রহণ করা। আর এসবই তাদের মূল উদ্দেশ্য। অবশ্য এসব সাংবাদিকদের আবার যশ-খ্যাতি বেশ ফলপ্রসূ। অন্যায়কারী, অপরাধীরা অনেক বড় সাংবাদিক হিসেবে মানুষের কাছে পরিচয় পাইয়ে দেয়। থানা-পুলিশ, অফিস-আদালত, বালুঘাটি, মাটি-কাটা কোথায় নেই তাদের চাটুকারিতা! সব জায়গায় তারা পানির মত মিশে যায়। কোথাও আটকায় না তারা। সেসব সাংবাদিকদের কোনো বিপদ নেই, কোনো ভয় নেই। বরং তারা অন্য সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা উল্টা-পাল্টা তথ্য অপরাধীদের দিয়ে তাদের শত্রুতে পরিণত করে। মফস্বলের সাংবাদিকতা রাজনীতি মোটামুটি রাজনীতি যুক্ত সেটি হতে পারে খোলামেলা বা গোপনে। রাজনীতি মুক্ত এবং পেশাদার সাংবাদিকতা করতে গেলেই সাংবাদিকদের দেওয়া ট্যাগ, সংবাদ করতে গিয়ে অনেক সময় সাংবাদিক নিজেই সংবাদের শিরোনাম হয়ে যায়। সাংবাদিকদের জীবনের যেন কোনো দাম নেই!
মফস্বল সাংবাদিকতাকে রক্ষা করার জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া উচিত।
তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে - বেতন দিয়ে এক জেলার সাংবাদিককে অন্য জেলায় পদায়ন করা অস্থায়ী হিসবে, পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া, রাজনৈতিক মুক্ত ব্যক্তিত্ব, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, আচার-আচারণ। এ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে সাংবাদিক নিয়োগ দিলে অন্তত কিছুটা অপ-সাংবাদিকতা রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। সেই সাথে নিরাপত্তার জন্য সাংবাদিক নিরাপত্তা আইন করা। তাহলে সংবাদকর্মীরা বস্তুনিষ্ঠ সঠিক সংবাদ জনগণের মাঝে তুলে ধরতে পারবে। জণগণ সঠিক এবং একতরফা সংবাদ থেকে রেহাই পাবে। তেলবাজি নিপাত যাক সঠিক সাংবাদিকতা ফিরে পাক।
শাকিল আহম্মেদ: ফুলছড়ি, গাইবান্ধা।
আজকালের খবর/আরইউ