প্রতিদিন মনে হয় জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা-সভ্যতার অস্তিত্ব বোধহয় শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই নিষ্ঠুরতম অমানবিক কর্মকাণ্ডে মানব জাতি বেশি পরিমাণে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। রক্তলোলুপ জিঘাংসু বাহিনীর বর্বরোচিত সন্ত্রাস-প্রতিসন্ত্রাসে সভ্যতার শরীরজুড়ে রক্তের আল্পনা। প্রশ্ন জাগে মনে, আমরা কোন সভ্যতায় বসবাস করছি? একবিংশ শতকে আমরা কী এই আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সভ্যতার কাছে চরম নৃশংসতা প্রত্যাশা করেছি। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ, সংঘর্ষ বা রক্তপাত হচ্ছেই। বলা যায়, এটিই এখনো বিশ্বের বাস্তবতা। পৃথিবী জোড়া এখনো অশান্তি, উত্তেজনা, সহিংসতা ও সংঘর্ষের চিত্রই প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। মানুষ যে শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রত্যাশা করেছিল, তা এখনো সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। হিংসা, হানাহানিই এখনো পৃথিবীর বাস্তবে। এই চিত্র অস্বীকার করার উপায় নেই। এ জন্যই মনে হয়, এতকিছুর পরও ওই আঁধার যেন গেল না। শান্তির পথে বাধা তো আরো আছে- ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি। এগুলোও শান্তির পথে কম বড় বাধা নয়। পৃথিবীতে একদিকে প্রাচুর্য ও অপচয়, অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করা না গেলে বিশ্বে শান্তির সুবাতাস প্রত্যাশা করা যায় না। এ জন্যই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এত জরুরি। এই পৃথিবীতে মানুষ যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। এই স্লোগানে আমরা ইতোমধ্যে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর নানা রকম কর্মসূচিও দেখেছি। ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন সংকট এবং সর্বোপরি ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী এই দাবি জানিয়েছে এবং এখনো এ দাবিতে শান্তিপ্রিয়রা সোচ্চার। কিন্তু মানুষের এই শুভ প্রত্যাশা বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
যুদ্ধ কিংবা দ্বন্দ্ব-সংঘাত নানা রকম ক্ষয়ক্ষতির চিত্রই স্ফীত করে। মানবতার পরাজয় ঘটায়। মানুষের পাশাপাশি সত্যেরও মৃত্যু হয়। আহত মানুষের আহাজারি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেকবান মানুষকে পীড়িত করে। চরমভাবে আঘাত লাগে অর্থনীতিতেও। সুন্দর ও মানবিক জীবন যাপনের জন্য শান্তি মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্যভাবে প্রেরণা জোগায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার, এর মধ্যে শান্তি অন্যতম। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির এই যুগে সভ্যতার ক্রমসম্প্রসারণ ও মানুষের দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার অপরিসীম বিস্তৃতি ঘটেছে বিপুলভাবে। এর পাশাপাশি মানুষে মানুষে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অভাবনীয় স্খলন-পতন-বিভেদ-বিদ্বেষ-বিপর্যয়- বীভৎস কার্যকলাপ ইত্যাদি তামসিক উল্লাস প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত করছে শুভচেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষ আজ দিশাহারা। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা শঙ্কায় অতিক্রম করছি জীবনের প্রতিটি ক্ষণ। প্রতিটি দিনকে মনে হয় ভয়ঙ্করতম দিন।এমন আতঙ্ক ও সংকট যেন আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে বিশ্বে সংঘাত ও যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৪৮ হাজার ৩৮৪ জন বেসামরিক মানুষ। যুদ্ধ পরিচালনা এবং যুদ্ধকালে বেসামরিক মানুষের প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও বিধি মেনে না চলার কারণে প্রতিবছর এভাবে নিহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট ইরাকের বাগদাদে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূতসহ ২২ জন মানবিককর্মী নিহত হন। নিহতদের প্রতি সম্মান জানানো ও মানবিককর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সুসংহত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতিবছর এই দিনটি বিশ্ব মানবিক দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে।
গোষ্ঠীস্বার্থ ও ভূরাজনীতির কারণে পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ থামাতে আন্তরিকতা ও অঙ্গীকারের অভাব সব কালেই দেখা যায়। তবে এসব ঘটনায় যাতে শত্রুপক্ষ ও ভুক্তভোগী মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ করা হয়, সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও আইনের সূচনা হয়। যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুদ্ধের বিবদমান পক্ষগুলো আইন বা কনভেনশন যথাযথ প্রতিপালন করে না। যার নির্মম উদাহরণ চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। প্রতিদিন ২৮ শিশুসহ গড়ে একশ বেসামরিক মানুষ সেখানে নিহত হচ্ছে। এরই মধ্যে মোট নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬১ হাজার ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ এক হাজার ৭৬০ ফিলিস্তিনি অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া এ যুদ্ধে আইএইচএল অবজ্ঞা করে ওষুধ, ত্রাণ ও জরুরি মানবিক সাহায্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টি, মৃতদেহের প্রতি অসম্মান, যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করা, হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনায় হামলা ও ধ্বংস, শত্রুপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণতা চলছেই। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের অন্ত নেই। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুদানের গৃহযুদ্ধ, নাইজেরিয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ইত্যাদি। এসব ঘটনার কারণে বিশ্বে শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এখন ১২ কোটি, যা বিশ্বজুড়ে মানবিক সংকট প্রকট করে তুলেছে। ২০২৪ সালে শুধু সংঘাতের কারণে সুদান, মালি, হাইতি, গাজাসহ ২০টি দেশে ১৪ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যের অভাবে মানবিক সংকটাপন্ন। জাতিসংঘের বর্ণনায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজন রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় এবং বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছে এখন নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ মানবিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং তাদের সহায়তায় নিয়োজিত মানবিককর্মীদের সুরক্ষায় বিভিন্ন চুক্তি ও অঙ্গীকার রয়েছে। এসব নীতি ও অঙ্গীকারের সাধারণ লক্ষ্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা, সুরক্ষা ও সহযোগিতাপ্রাপ্তিকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদাপন্ন মানুষের সক্ষমতাকে স্বীকৃতিপূর্বক মানবিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিপদাপন্নতা হ্রাসকরণ। যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দায়বদ্ধতার অভাবে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রায়ই। আমাদের দেশেও সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু ও অমানবিক হয়ে উঠছে। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ১৪০০ নিরস্ত্র মানুষ নিহত হন, যা জাতিসংঘের বর্ণনা এবং সাধারণ বিবেচনায় মানবতার লঙ্ঘন। বিশ্বব্যাপী লঙ্ঘিত মানবতা সত্ত্বেও আশাহত হওয়ার সুযোগ নেই। ইসরায়েলি প্রতিরোধের ঝুঁকি উপেক্ষা করে গাজায় ক্ষুধার্তর জন্য সুইডিশ তরুণ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলিন’ গাজা অভিমুখে ছুটে চলা, ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার পর নিজ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ, ২০২৪-এর আন্দোলন চলাকালে পরিশ্রান্ত ছাত্র-জনতাকে এক তরুণ মুগ্ধের ‘পানি লাগবে পানি’ আহ্বানের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া-এমন অনেক উদাহরণ আমাদের মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। বিশ্বে নতুন করে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষের জীবনে আরো দুর্দশা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তির অনুকূল নয়। বিশ্ব শান্তির স্বার্থেই বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা পড়ে তুলতে হবে।
একই সঙ্গে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যে মানুষ খেতে পায় না, অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত- তার শান্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু শান্তি আজ মানুষের প্রায় শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব শান্তি ছাড়া এ বিশ্ব সভ্যতাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। শান্তির কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিষয়টি ঘুরেফিরে আসে। ইউরোপের কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রুশকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের কাছে ক্রেমলিনকে অবৈধ প্রতিপন্ন করা যাবে- পশ্চিমাদের এমন চিন্তার কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর ওই যুদ্ধ মহড়ার চিন্তা কোনোমতেই এড়ানো যাচ্ছে না। কারণ তখনকার যুদ্ধের হুমকিকে অযৌক্তিক হুমকি বলেই মনে হতো। আলবেনীয়দের মতোই ইউক্রেনীয়রাও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অতিশক্তি প্রয়োগের রাজনীতির এক ভয়াবহ দাবা খেলার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে। এখন অনেকের কাছেই এ বৈরিতার সমাপ্তিকে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ‘টুওয়ার্ড পারপেচুয়াল পিস’ গ্রন্থে উল্লিখিত শান্তির মতোই মনে হবে। প্রকৃতপক্ষে আশা বসবাস করে ইচ্ছা ও বিশ্বাসের মধ্যে। আশার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ঠিক তখনই-যখন বিশ্বকে আশাহীন মনে হয়। আশা পৃথিবীতে সহজলভ্য এবং আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন-এমন নয়। পৃথিবীবাসীর স্বস্তি, শান্তি, কল্যাণ ও প্রগতি ত্বরান্বিত এবং নিশ্চিত করার স্বার্থে শান্তিবাদী আঙ্গিকের একটি শুভতর প্রবর্তনার বিষয়টি অবশ্যই মানবিক বিবেচনায় রাখার উদ্যোগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে এটি নির্ভর করে আমরা পরস্পরকে ধ্বংসের লক্ষ্যে দেখব, নাকি সমকক্ষ মানুষ হিসেবে দেখব-এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ