
‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি দিবস’ উপলক্ষে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার শহিদ পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
রবিবার (৩ আগস্ট) জুলাই বিপ্লব প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ১৭ শহিদ পরিবারদের উপহার এবং বিপ্লবে গ্রেপ্তার হওয়া ৩১ জন শিক্ষার্থীদের ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
জুলাই বিপ্লব বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী ও কোষাধ্যক্ষ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই বিপ্লব প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে কুষ্টিয়া জেলায় ১৬ জন এবং ঝিনাইদহ জেলায় ১৩ জন শাহাদাত বরণ করেছে। তাঁদের পরিবারের সাথে স্মৃতিচারণ এবং অভিজ্ঞতাগুলো শুনে গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনদের পক্ষ থেকে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ.বি.এম সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফী বলেন, ‘শহিদ পরিবারের প্রতি সম্মান রেখে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ করছি।’
ইবি সাদা দলের আহ্বায়ক ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক ড. মতিনুর রহমান বলেন, ‘অনেকে এই সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলে কিন্তু আমি বলি মাফিয়া সরকার। ৪ তারিখ যখন আমরা অংশগ্রহণ করেছিলাম তখন আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার রুজু করেছিল৷ সরকার পতন না হলে আমাদের চাকরি তো থাকতো না, বরং বেঁচে থাকাটা অনিশ্চিত ছিল। ৫ আগস্টের আগে আমরা একতাবদ্ধ ছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে এসে ফাটল লক্ষ করা যাচ্ছে।’
বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আজকের দিনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অংশগ্রহণ করায় মোট ২৮ জন শিক্ষকদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার রুজু করেছিল। শহিদ পরিবারের প্রতি সুনজর এবং দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক উপাচার্যকে অনুরোধ করছি।’
এ সময় কারাবরণ করা ইবি শিক্ষার্থী জাকারিয়া হোসেন (শিবির কর্মী) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘সেইদিন কুষ্টিয়া শহরের আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু মুসা ভাই কর্মীদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন যে, যতই প্রতিকূল পরিবেশ হোক না কেন একটা কর্মীও পিছু হটা যাবে না।’
প্রথম গ্রেপ্তারকৃত ইবি শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান (ইইই বিভাগ ২০১৭-১৮) বলেন, ‘আমি ৭১ দেখিনি কিন্তু চব্বিশের জুলাই দেখেছি। যারা আন্দোলনে গিয়ে ফিরে আসেনি এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাদের অবদানের চেয়ে আমি খুব নগন্য। সেইদিন গ্রেপ্তার করে মোবাইল কেড়ে নিয়ে হাজতে নিয়ে নেয়। পানি, খাবার দিত না বরং বোতল মাথায় দিয়ে ঘুমাতাম। আমাদের শিক্ষকরা চেষ্টা করে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
শহিদ বাবলু ফরাজের সন্তান সুজন মাহমুদ ফরাজ বলেন, ‘সব ভেদে ভুলে গিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ দীর্ঘ বছর সাধারণ মানুষদের গুম, খুন, নির্যাতন করেছে। এদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
শহিদ ইউসুফের মেয়ে শিমা খাতুন বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমিও ঘরে বসে থাকতে পারিনি, অংশগ্রহণ করেছি। আব্বা যখন গুলি খেয়ে মারা যান, তখন গিয়ে দেখি একসাথে ৩ জন গুলিবিদ্ধ শহিদ দেখে প্রথম বুঝতে পারছিলাম না। আব্বার পা দেখেই বুঝতে পেরেছি ওনি আব্বা। সেইদিনগুলো ভুলার মতো নয়।’
শহিদ সবুজের স্ত্রী রেশমা খাতুন বলেন, আমরা স্বামী জীবন দিয়েছে দেশের জন্য, জাতির জন্য সেটা যাতে দেশ মনে রাখে। আমরা হাসবেন্ডের ব্যাপারে মামলা করেছি, ১১ জন গ্রেফতার করেছে, কিন্তু এখনও বিচার করা হয়নি। আমরা কিছু চাই না তবে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। সকল শহিদ পরিবারের প্রতি সুনজর রাখবেন। আমি সুবিচার চাই এবং খুনিদেরকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চাই।
শহিদ সবুজের স্ত্রী রেশমা খাতুন বলেন, আমরা স্বামী জীবন দিয়েছে দেশের জন্য, জাতির জন্য সেটা যাতে দেশ মনে রাখে। আমরা হাসবেন্ডের ব্যাপারে মামলা করেছি, ১১ জন গ্রেফতার করেছে, কিন্তু এখনও বিচার করা হয়নি। আমরা কিছু চাই না তবে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। সকল শহিদ পরিবারের প্রতি সুনজর রাখবেন। আমি সুবিচার চাই এবং খুনিদেরকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইবি শাখা সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন‚ শহিদদের আর্তনাদের কথাগুলো শুনে পরবর্তীতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। আজকের দিনে শিক্ষকরা আমাদের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিলেন। অনুরোধ থাকবে- আমরা জুলাইকে হারাতে না দিই। বিভাজনের ষড়যন্ত্রে পা না বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘এটা শুধু স্মৃতিচারণ মূলক অনুষ্ঠান নয় বরং এটি সেই বিপ্লবী দিনগুলোকে স্মরণ করা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, ‘আন্দোলনে আমি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু এতে আমার কৃতিত্ব আছে বলে মনে করি না। এ ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর জন্য আন্দোলন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। আমরা জানি ৩৬ শে জুলাইয়ের আন্দোলনটা মেধার মূল্যায়নের আন্দোলন ছিল। সেই সময় সরকার মূল্যায়ন না করে মহোৎসব পালন করেছিলেন। যার কারণে পতনের সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে যে সরকার আসুক এই স্প্রিট ধারণ করবে কি-না আমি জানি না।আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। নাহলে ফ্যাসিস্টের মতো পালানোর জায়গা পাবো না। শেখ হাসিনার সৌভাগ্য যে তার বন্ধুরাষ্ট্র ছিল, কিন্তু এ সরকারের কোনো পাশের বন্ধু রাষ্ট্র নাই। সুতরাং পালানোর সুযোগও নাই। সুতরাং যে দেশ শাসন করবেন, হিসাব করে দেশ শাসন করতে হবে। দুঃখের বিষয় চব্বিশের বিপ্লবকে আমি বিপ্লব বলতে পারি না। কারণ বিপ্লবের যে উপাদান তা এতে খুঁজে পাচ্ছি না বরং ফ্যাসিস্টরা ঘাপটি মেরে বসে আসে। তাদেরকে সরাতে পারলেই বিপ্লব সফল হবে।’
ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, রক্তের বিনিময়ে সবসময় পরিবর্তন সাধিত হয়। আর রক্ত দিতে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি জাতিকে জাগ্রত হতে হয়। ঐক্যবদ্ধ না হলে ফ্যাসিস্ট শাসনকে উৎপাটিত করা যেত না। আমাদের জাতি যে দেশ পেয়েছে সেই দেশ আর পেছনে ফিরে যাবে না। আর গণতন্ত্রহীন হবে না, বৈষম্যমূলক হবে না। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিজেকে নিবেদিত করতে হবে।
তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে আহ্বান করে বলেন, শহিদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা কোনো একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনারা একটি সুন্দর দেশ গড়ুন, না হলে শহিদের রক্তের ঋণ শোধ হবে না।
উপাচর্য আরো বলেন, আমরা চলে যাব কিন্তু আগামী প্রজন্ম যেন শহিদ পারিবারকে স্মরণে রাখে। তাদের যেন আমরা ভুলে না যায়। ইতোমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা শহিদের নামে নামকরণ করেছি। ক্যাম্পাসে আগামীর স্থাপনা গুলো ছাত্র-শিক্ষদের মতামতের ভিত্তিতে শহিদ ও ইবি'র বরেণ্য ব্যক্তিত্ব যারা এই ক্যাম্পাসের জন্য রক্ত দিয়েছিল তাদের নামেই নামকরণ করা হবে। এছাড়া আমরা সকলে আজীবন শহিদের জন্য দোয়া করবো, তারা না হলে আমি এখানে থাকতাম না। শহিদের রক্তের বিনিময়ে একদল বেঁচে যায়, তাদের দায়িত্ব থাকে সেই রক্তের ঋণকে শোধ করা। আমরা যেন সেই রক্তে ঋণ শোধ করতে পারি। সরকার যেন জুলাইয়ে স্পিটকে ও শহিদদের ভুলে না যায়। না হলে কিন্তু আবার সেই ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আমাদেরকে সকল ষড়যন্ত্রের ঐক্যবদ্ধ ভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
আজকালের খবর/ওআর