
১৮ জুলাই ২০২৪, দিনটি যেন স্মৃতির পাতায় স্থায়ীভাবে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এই দিনটি ছিল কান্না, রক্ত আর আর্তনাদের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সেদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল, আর যার প্রতিফলন ঘটেছিল এক ভয়াবহ সহিংসতায়।
সকালের শান্ত আকাশ হঠাৎ যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠল সাড়ে এগারোটার দিকে। হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণায় কেঁপে উঠল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। কণ্ঠে একই দাবি ‘কোটার নামে বৈষম্য চলবে না’। কেউ পোস্টার হাতে, কেউ মুখে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছিল কোটবাড়ি বিশ্বরোডের দিকে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাস্তা যেন প্রতিবাদের এক জীবন্ত ক্যানভাস হয়ে উঠেছিল।
বিশ্বরোডে পৌঁছাতেই চোখে পড়ল প্রস্তুত অবস্থানে আছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি। তখনও কেউ ভাবিনি কী ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে।
শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়লে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তোলে। ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দুইটি এপিসি ভ্যানে আগুন লেগে যায়। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল চারপাশ। কান্নার শব্দ, দমবন্ধ করা গ্যাসের ঝাঁজ আর ছুটে চলা মানুষের আর্তচিৎকার সবকিছু মিলিয়ে যেন রণক্ষেত্র।
ঠিক ১টা ২১ মিনিটে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটি দৃশ্য ১৪ বছর বয়সী এক শিশুকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য পিটিয়ে চলেছে; কেউ লাঠি দিয়ে মারছে, কেউ লাথি, কেউ চুল ধরে টানছে। কিছুক্ষণ পর শিশুটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল রাস্তায়।
বেলা ২টার দিকে আহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো ছুটে চলে গেল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। সেই মুহূর্তে এক পথচারী, যার হাতে ছিল বিস্কুটের প্যাকেট, রাস্তা পার হতেই এক পুলিশ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। বিস্কুট গড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, আর মানুষটি জীবন নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। তার কী দোষ ছিল সেই প্রশ্নটি এখনও উত্তরহীন।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রাস্তার বিপরীত পাশে একজন পুলিশ সদস্য বিচ্ছিরী ভাষায় গালি দিতে থাকে, পাশ থেকে অন্য একজন পুলিশ সদস্য বলেন, তার গুলি শেষ হয়ে গেছে সে জন্য গালি দিচ্ছে। যেন গুলি আর গালির পার্থক্য ছিল না সেদিন তাদের কাছে।
বিকাল চারটার দিকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। অনেকেই আশাবাদী হয়ে পড়ে। কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন পুলিশ সদস্যরা। বলেন, “সরকার দাবি মেনে নিয়েছে, বাসায় ফিরে যান।”
কিন্তু, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছুড়তেই ফের শুরু হয় হামলা। দ্বিতীয় দফায় পুলিশের তাণ্ডবে আহত হয় আরও অন্তত পঞ্চাশজন।
ঠিক ৪টা ২৪ মিনিটে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন শ্রমিককে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। একজন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান, আরেকজন গুলিবিদ্ধ হন মুখে। পুলিশের উদ্দেশ্যে হাত ইশারায় আহতদের একজনকে সাহায্য করার অনুরোধ জানাতে চাইলেও, সাহায্যকারীকে লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হয় টিয়ারশেল। দম বন্ধ হয়ে আসা সেই মুহূর্তে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে আশ্রয় নেওয়া হয় পাশ্ববর্তী একটি হোটেলে। এভাবেই চলতে থাকে গুলির শব্দ, আর্তনাদ, আতঙ্ক দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত।
সন্ধ্যার পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ ফজলে রাব্বি জানান, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অন্তত ৫৩ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু ভেতরের বাস্তবতা ছিল আরও ভয়াবহ। গ্রেপ্তারের আতঙ্কে অনেকেই হাসপাতালে না গিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. করিম জানান, ‘প্রায় সবাই ছররা গুলির আঘাতে আহত। এছাড়াও টিয়ার শেলের গ্যাস আর লাঠিপেটায় আহত হয়েছে।
আজকালের খবর/ওআর