মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫
‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি
ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
প্রকাশ: শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫, ৪:১০ পিএম
এক. নতুন বইয়ের মলাটে একদিকে যেমন থাকে নতুনত্বের ঘ্রাণ, তেমনিই থাকে না-বলা কিছু কথা, থাকে নতুন শৈলী ও শিহরণ-যা পাঠ করে পাঠক আনন্দে আত্মহারা হতে পারে। আবার বিষণ্ন বেদনায় তার বুকটা বিদীর্ণও হতে পারে। এমন কিছু না ঘটলে সেই বইয়ের মূল্যই বা কোথায়? আর যদি সে বই হয় নজরুল জীবনের অব্যক্ত কানা- ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ । পাঠ- অভিজ্ঞতায় বলতে চাই- বইটির উপস্থাপনায় দারুণ চমক আছে; আছে রোমান্টিসিজমের এক নির্মোহ-নিদারুণ উচ্চারণ। তাই বলে বাস্তবতা বর্জিত নয়। ঠিক শুরুতেই দেখতে পাই- কবিপুত্র সানি সদ্য সমাহিত পিতার কবরের মাটি স্পর্শ করতেই বেদনায় বিদ্রোহী কবির হৃদয় হুহু করে ওঠে। একে একে কবি বলতে শুরু করেন তার জীবনপর্বে ঘটে যাওয়া নিদারুণ সব করুণ কাহিনি। সেই কাহিনি কেবল তার নিজের নয়, তার দেশ, তার সমাজ-সংস্কৃতি, তার সাহিত্য-সৌরভ, তার রাজনীতি, তার পূর্বপুরুষের পরিচয় ইত্যাকার নানাবিধ না-বলা সব অন্তহীন দুঃখকথা। গ্রন্থটি বিদ্রোহী কবির জবানে উপস্থাপিত। এটি পড়তে গেলে বিদ্রোহী কবির জীবন ও জগতের, তার সমসাময়িক সময় ও সমাজের, তার কাল ও কালান্তরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাপঞ্জি আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভিডিওগ্রাফির মতো ভেসে যেতে থাকে। এইসব ভিডিও দেখে আমরা কখনো আনন্দে উদ্বেলিত হই, কখনো বেদনায় বিমুঢ় হয়ে যাই। আমরা বিদ্রোহী কবির সরব ও সচল উপস্থিতি টের পাই, টের পাই কবি মজিদ মাহমুদকেও। মজিদ মাহমুদ পাঠকের হাত ধরে নিয়ে যান নজরুল-জীবনের অন্দরমহলে, পরম মায়া ও মমতায় দেখিয়ে দেন বিদ্রোহী কবির উন্মেষ ও উত্থান, তার বিকাশ ও বিস্তার; সমসাময়িক সময় ও সমাজের সাংস্কৃতিক নানা পর্ব ও পর্বান্তরের পূর্বাপর পরিচয়-বৃত্তান্ত। 

গ্রন্থটিতে মজিদ মাহমুদ নজরুল প্রসঙ্গে প্রচলিত ধারণাকেই কেবল ভেঙ্গে দিচ্ছেন না, নতুন করে নজরুলকে আবিষ্কারও করছেন। সেই আবিষ্কারে বিষ্ময় ও বিতর্ক থাকতে পারে; থাকতে পারে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই বিষ্ময় ও বিতর্ক থাকলেও এটিকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ কি কোথাও আছে? সাধারণত প্রান্তজনের প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্রোহী কবিকে বিবেচনা করা হয়, বিবেচনা করা হয় গরীব-ঘরের এক অসহায় সন্তান হিসেবে। বাল্যবেলায় যাকে ডাকা হতো দুখু মিয়া নামে। এই পথ স্বীকার করেও মজিদ মাহমুদ নতুন আলাপ নিয়ে হাজির হচ্ছেন; দেখিয়ে দিচ্ছেন- মোঘল আমলে বিদ্রোহী কবির পূর্বপুরুষের স্থানীয় বিচারবিভাগে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনসহ গৌবরময় সব অতীতকথা। শাসনকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়াতে তার পূর্বপুরুষের হাজীপুর থেকে চুরুলিয়ায় আগমন এবং এখানকার আয়মা সম্পত্তির মালিক হওয়া- এসব তো বংশমর্যাদা ও আভিজাত্যের স্বাক্ষরই বহন করে। নয় কি? সেই স্বাক্ষর ও সৌরভ তার ধমনী, তার মন ও মননে সচল থাকাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। 

মজিদ মাহমুদ আরও দেখিয়ে দিচ্ছেন বিদ্রোহী কবির ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার এক উর্বর উত্তরাধিকার। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও জয়দেবের ন্যায় যুগশ্রেষ্ঠ কবির জন্মভিটে, অজয় নদীতীরে (কেন্দুলি) জয়দেবমেলায় বাউলসহ হিন্দু-মুসলমানের সারাবছর সম্মলিত সাংস্কৃতিক উৎসব ও উন্মাদনা, কাছেই কবিগুরুর বোলপুর আশ্রম- এই বোলপুর, এই বর্ধমান, বীরভূম, অজয় ও চুরুলিয়ার সমবায়ী সাংস্কৃতিক সত্তার এক স্বতন্ত্র সুর ও সারাৎসার বিদ্রোহী কবিমনে বাল্যবেলা থেকেই যে সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল- মজিদ মাহমুদ সেই সব বিষয় বেশ ভালোভাবেই তার পাঠককে দেখিয়ে দিচ্ছেন; দেখিয়ে দিচ্ছেন চণ্ডীদাসের ঐ অমর বাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কীভাবে নজরুলের মনোজগতে বিপুল ঢেউ তুলেছিল। যে ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তার যাপিত জীবনে, তার সাহিত্যে ও সঙ্গীতে, তার সৃজনকলায় নানা শাখাপ্রশাখায়। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অতুল হিমাদ্রি। নজরুলের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা, এই সাংস্কৃতিক সত্তা কেবল কবিতার ছন্দেই দোল খায়নি, কেবল কীর্তন-ভজন কিংবা ইসলামি সংগীতসুরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; নজরুল তার পারিবারিক জীবনেও ঐ অসাম্প্রদায়িক ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন, উড়িয়েছিলেন নতুন সুর ও সাহিত্যের বিজয়-পতাকা। প্রমীলা ওরফে দুলির মতো সনাতনী মেয়েকে ভালোবেসে ঘরে তোলা, শাশুড়ী গিরিবালার সঙ্গে একই বাড়িতে সহাবস্থান করা, সন্তানের নাম কৃষ্ণ মুহম্মদ রাখা- এই সব ঘটনা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার দারুণ সব দৃষ্টান্ত। এজন্য নজরুল যে কেবল প্রশংসা কুড়িয়েছেন তা-ই নয়, দুর্নামও তার কপালে একেবারে কম জোটেনি।

দুই. ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ বইটির পাতা উল্টাই। আর অমনি একগাদা প্রশ্ন হুড়মুড় এসে আমাদের সামনে হাজির হয়। বিদ্রোহী কবির জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নানা সংকট ও সমস্যা কবির জীবনকে কীভাবে বিপর্যস্ত করেছিল-মজিদ মাহমুদ এই সব বিষয় আমাদের সামনে হাজির করছেন। ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় কোম্পানির গাড়ি কেড়ে নেওয়া, অনিয়মিত বেতনভাতা, ধারদেনা করে সংসার চালানো, হাইকোটে পাওনাদারের মামালা দায়ের, মামলার ওয়ারেন্ট অর্ডার-এই অপ্রত্যাশিত বিষয়-আশয় কবিজীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল। উপরন্তু সন্তানের মৃত্যু, স্ত্রীর পক্ষাঘাত রোগ, অতঃপর নিজেরও নির্বাক হয়ে যাওয়া, নিস্তদ্ধ হয়ে যাওয়া, বেশকিছু সহায়তা ফান্ড গঠিত হলেও এর অপ্রতুলতা, প্রাদেশিক সরকারের ভাতা মঞ্জুর হলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যাওয়া, সিফিলিস ভেবে আন্দাজে চিকিৎসা করা, দশ লক্ষ পাওয়ারের পেনিসিলিন পুশ করা, শেষমেষ কলকাতার লুম্বিনী পার্কের লুনাটিক অ্যাসাইলামে ভর্তি করা, পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা- এই সব নিদারুণ ঘটনা পাঠে পাঠকের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। ভাবতে অবাক লাগে, যে কবির সঙ্গীত শোনার জন্য সঙ্গীতপ্রেমিরা অধীর হয়ে থাকতো, যে কবির কবিতা হুড়মুড় করে বিক্রি হয়ে যেতো, যার সম্পাদিত কাগজ সংগ্রহের জন্য পাঠকরা জটলাবেঁধে মোড়ে মোড়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতো- সেই কবির কি এতো আর্থিক অভাব-অনটন হওয়ার কথা? তাহলে প্রকাশকরা কি কবিকে ঠকিয়েছিল? গ্রামফোন কোম্পানি কি ঠিক মতো কবির পাওনা পরিশোধ করেছিল? যে কবিকণ্ঠে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল, যে কবির নাম শাসকগোষ্ঠীর খাতার বিদ্রোহী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়েছিল, যে কবির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল, স্বাধীনতার কথা লেখায় যে কবিকে শাসকগোষ্টী গ্রেফতার করে কারাগারের চারদেয়ালের প্রকোষ্ঠে বন্দি করেছিল- সেই কবির কিস্টোফার রোডের সরকারি বাড়িটির বরাদ্দ কেন বাতিল করা হয়? সেই কবির জীবনসায়াহ্নে, সেই কবির বিপদকালে রাষ্ট্র কেন তার সুচিকিৎসার সু ব্যবস্থা করতে পারে না। সেই কবিকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে কেন একযুগ সময় লেগে যায়? বিদেশে পাঠালেও টাকার অভাবে সঙ্গীসাথিদের কেন আলাদা আলাদাভাবে দেশে ফিরে আসতে হয়? রবীন্দ্রসদনে সংবর্ধনার জন্য কেন সত্তরতম জন্মদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়? কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার কবিকে আনতে চাইলে ভারতবর্ষের সম্মতির কারণ কি? অন্য কোনো কবিকে চাইলে ভারতবর্ষ কি সম্মতি দিতো? 

এই সব প্রশ্নের উত্তর কি এই যে, সাহিত্যে কবির আর করার কিছু ছিল না? অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে কবির সমাধি হওয়ার কারণটাইবা কি? এটি ঠিক যে, কবি মসজিদের পাশে কবর চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই কবর তো চুরুলিয়ার মসজিদের পাশেও তো হতে পারতো। যেখানে শায়িত আছে কবির পরম পিতামাতা, যেখানে শায়িত আছে কবির প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা ওরফে দুলি। যে মসজিদে কবি নিজেও আজান দিয়েছেন, যে মসজিদে কবি নিজেও নামাজ পড়েছেন, নামাজ পড়িয়েছেন। সেখানেই তো কবির কবর হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। এছাড়া কবির দাফনের পেছনে এতো তাড়াহুড়োর কারণইবা কি থাকতে পারে? আর একটুখানি সময় পেলেই কবিপুত্র সানি কবির মুখটুকু অন্তত শেষবারের মতো দেখতে পেতেন। নাকি এমন সংশয় ছিল যে, কবিপুত্র কবিকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন-এরকম বহু জিজ্ঞাসা, বহু প্রশ্ন মাথায় তোলপাড় করে বেড়ায়। সব না হলেও মজিদ মাহমুদের এই উপন্যাসের নিবিড়-পাঠে খানিকটা উত্তর মিলতে পারে। কবির নিদারুণ দুঃখকথা শুনে সত্যি হৃদয়টা ভারি হয়ে আসে। এজন্যই কি মজিদ মাহমুদ উপন্যাসটির সার্থক নাম-‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’।

তিন. লেখক এই উপন্যাসটিতে সমসাময়িক অজস্্র বিষয় ও বিন্দুকে একটি জায়গায় মেলাতে চেয়েছেন। পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ উল্টালে সমসাময়িক শাসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও চিকিৎসকসহ অজস্র ব্যক্তি ও বিষয় মিছিলের মতো এসে একটি জায়গায় যুক্ত হয়। অর্থাৎ নজরুলের জীবন ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় পুরো ভারতবর্ষীয় সমকালীন ইতিহাস মজিদ মাহমুদ এই গ্রন্থে তুলে এনেছেন। ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ লেখার পর গবেষক গোলাম মুর্শিদ ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে এক নিবন্ধে জানিয়েছিলেন, নজরুল নিয়ে নতুন করে আবিষ্কারের তেমন কিছু নেই। কিন্তু ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসটির পাঠ নিলে দেখা যাবে, নজরুল নিয়ে ভাবনার অনেক কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেছে। নজরুল নিয়ে নতুন করে পাঠককে ভাবতে হবে। মজিদ মাহমুদের এই গ্রন্থটি সেই ভাবনার খোরাক জোগাবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
সরকার সবার সঙ্গে সমান আচরণ করছে: প্রেস সচিব
২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে দেশে দুজনের মৃত্যু
বিচিত্রায় ৪৭ বছর আগের জয়া ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার
প্রশংসা কুড়াচ্ছে জয়ের ‘ধোকা’
ইরানে ইসরায়েলের হামলায় নিহত প্রায় ৪৫০ জন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
টেকনাফে বাস থামিয়ে পরিবহন কর্মীকে অপহরণ, ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি
দুপুরের মধ্যে ৮ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস
ভারতে পালাবার সময় তানোর যুবলীগ সেক্রেটারি আটক
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান
মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ২১ মুসলিম দেশ
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft