গভীর রজনী, পাখির কিচিরমিচির সুরে সুপ্রভাত উঁকি দেওয়ার পালা। শুনসান নীরবতা, তবে চারদিকে ঝিঁঝি পোকার যাত্রাপালা। দায়িত্বই একমাত্র সঙ্গী। হাতে নেই তাদের এনালগ কিংবা ডিজিটাল ঘড়ি। বরং ভোরের শিশির আর সূর্যের হাসির সাথে তাদের একাকিত্ব নিত্য-নৈমিত্তিক বিধিতে সরে দাঁড়ায়। এভাবে নিঃসঙ্গতায় কেটে যায় আস্ত রজনী। এই যেন প্রকৃতির অমোঘ সহজাত চক্র। ইচ্ছের অভিলাষে কিছু করার সক্ষমতা থাকে না কোনো আবদার।
মানুষ সামাজিক জীব- এই কথার মর্ম হয়তো কম বেশি জানি বা বুঝি। কিন্তু একাকিত্ব যে সমাজের স্তম্ভ সেটা পরোক্ষভাবে প্রমাণ করে দেয় নাইটগার্ড কিংবা রাতের নিরাপত্তা কর্মী নামের অতন্দ্র প্রহরীরা। বলছি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আনসার বাহিনীর অব্যক্ত আত্মকাহিনী। কাঁধে রয়েছে গুরুদায়িত্বের ভার। একই পোশাকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব কাঁধে ক্যাম্পাসকে আগলে রাখছেন তারা।
একা থাকলেই যে একাকিত্ব নয়- এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নাইমা ইসলাম অন্তরা। তার মতে একা থেকেও নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব কাটিয়ে ভালো থাকা যায়। একা থাকার প্রধান সুবিধা হলো স্বাধীনতা। স্বাধীন থাকার কারণে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া যায়। কিন্তু আনসার মামারা কতটা স্বাধীন? সম্ভবত জরুরতই তাদের একমাত্র স্বাধীনতা। যদি শীতকালীন ও ধর্মীয় উৎসবসহ বিভিন্ন অবকাশে যায় বিশ্ববিদ্যালয়, তখন দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা একাকিত্বের থাবা থেকে রেহাই পায় না।
যদিও একা থাকা মানেই কিন্তু একাকিত্ব নয়। কখনও কখনও চারপাশে অনেক মানুষ থাকলেও নির্দিষ্ট মানুষ বা সত্তার অভাবে একজন মানুষ নিজেকে নিঃসঙ্গ ও একাকী মনে করে। যদি কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর দরুণ একাকিত্বের বেড়াজালে আটকায় তখন একা থেকেও ভীষণ আনন্দ অনুভব করে। এদিক থেকে আনসার মামাদেরকে রিজিকের সন্ধানের বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ায় একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা তেমন গ্রাস করতে পারে না। তখন মূখ্য ভূমিকা হয়ে ওঠে একাকিত্বই তাদের দায়িত্ব।
সাধারণত একাকিত্ব নিয়ে আমরা সব সময় ভুল ধারণা পোষণ করে থাকি। আমরা মনে করি, একা থাকাটাই হচ্ছে একাকিত্বের কারণ। অথচ একা থাকা মানেই একাকিত্ব নয়। কেন-না, হাজার মানুষের ভিড়েও কেউ কেউ একাকী বোধ করে, একাকিত্ব পুষে বেড়ায়। আবার নিশ্চুপ নির্জনে বসেও কেউ কেউ একাকিত্বের থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। নিঃসঙ্গতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রম্ম রিচম্যান। তার মতে, নিঃসঙ্গতা একটি আবেগের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা।
নিজেই নিজের সঙ্গী হিসেবে নেয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে লক্ষণীয়। তবে একাকিত্বের সমাধান যে বের করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কিন্তু নেই। যদি একাকিত্বকে কোনো ব্যক্তির কাছে সমস্যা বলেই মনে না হয়, তবে সেটি সমাধানের প্রশ্নও তো উঠছে না। নিজের সঙ্গে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেন যারা, তাদের আসলে অন্য কোথাও হন্য হয়ে সঙ্গ খুঁজতে হয় না। যেটির দৃষ্টান্তই হলো প্রহরী মামারা।
পঞ্চাশার্ধ্বো মনসুর আলী নামের জ্যেষ্ঠ আনসার মামা বলেন, ১৯৯৬ সালে আনসার বাহিনীর ট্রেনিং নিয়ে ২০০১ সালে চাকরিতে যুক্ত হই। শুরুতে সম্মানী বাইশশো ছিল তবে এখন ষোলো হাজার ট্যাহা পাই। চব্বিশ বছর এই বাহিনীতে আছি। আল্লাহ বরকত দেয়।
একাকিত্বের বিষয়ে তিনি জানান, পরিবারের ভার কাঁধে থাকলে একাকিত্ব ছুঁইতে পারে না। যখন মনে হয় একাকী আছি তখন তসবিহ, কুরআন, তাহাজ্জুদ নামাজ ও বই পড়ে কাটিয়ে দেয়া হয়। অগণিতবার কুরআন খতেম হয়েছে। অনুবাদসহ একবার শেষ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাপ্পি নামের আরেক আনসার মামা জানান, এটা একাকিত্ব নয় বরং দায়িত্ব। দায়িত্ব যত একাকী করা যায় ততই নির্ভেজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতকালীন ছুটির কারণে একটু শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কম। তবে স্বাভাবিক সময়ে একাকী মনে হয় না। অনেক শিক্ষার্থী আইসা আমাদের সাথে খোশগল্প করে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে দায়িত্বে ছিলাম তখন বিভিন্ন মানুষ ছোট করে দেখতো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আচরণ ভালো বরং পিতৃতুল্য সম্মান দেয়।