রাজনীতি সচেতন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩, ৭:৪০ পিএম
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি সমাজের অধঃপতন  আর অস্থিরতার চালচিত্র নিপুণ  শিল্পীর মতো এঁকেছেন, যা তার সাহিত্যকে এক অনন্য শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রদান করেছে। তখনকার  সমাজের বাস্তবতা,  মানুষের চাওয়া পাওয়ার গল্প তার উপন্যাস ও ছোটগল্পকে অসম্ভব  গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার অনন্য স্বকীয়তাই তাকে যুগউত্তরণ করতে সহায়তা করেছে। ব্যক্তি তারাশঙ্কর মনে করতেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। এই বিশ্বাস আমরা তার উপন্যাস, ছোটগল্প,  প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাই। সমাজিকভাবে  বিত্তশালী পরিবারের মানুষ  হলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার নৈকট্য  তারাশঙ্করকে এক অপরিমেয় শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য  করেছিল। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ‘আমার কালের কথায়’ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তার জননী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার বাবার মতো প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ মানুষের জীবনকে শান্ত সংযত বেগবান প্রবাহে পরিণতি তিনি দিতে পেরেছিলেন।’

তারাশঙ্করের জন্ম সাল ১৮৯৮, সেদিনগত তারিখ ছিল ২৩ জুলাই। পিতা হরিদাস বন্দোপাধ্যায়, জননী প্রভাবতী দেবী।  তারা মার প্রসাদে পুত্র জন্ম হয়েছিল বলেই হরিদাস বন্দোপাধ্যায় পুত্রের নামকরণ করেন তারাশঙ্কর। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জীবনে জননী ব্যতীত অন্য আর এক মহিলার ব্যাপক প্রভাব ছিল, তিনি পিসিমা। পিসিমা ছিলেন অসামান্য ব্যক্তিত্বময়ী, তার শাসন এবং নির্দেশে কেটেছে তারাশঙ্করের বাল্যজীবনের দিনগুলো । পাঁচবছর  বয়সে হাতেখড়ি হয় তার। তারাশঙ্করের জীবনে অসামান্য অবদান ছিল মাতা প্রভাবতী দেবীর, পিতার মৃত্যুর পর পিসিমার নির্দেশেই চলত হেঁসেলের খুঁটিনাটি। এই পিসিমা চাইতেন তারাশঙ্কর বড় হয়ে জমিদার হয়ে উঠুক, কিন্তু মা তা চাইতেন না। জমিদারির বাইরের যে অনন্ত জগৎ রয়েছে সেইখানে নিজেকে উন্মুক্ত, পরিব্যপ্ত করে দিক তারাশঙ্কর, এমনই চাইতেন জননী প্রভাবতী দেবী। শেষমেষ জয়ী হয়েছিলেন জননী প্রভাবতী দেবীই , জীবনের এক পর্বে এসে, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় লাভপুর এবং জমিদারী ত্যাগ করে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ভগ্নস্বাস্থ্যর অধিকারী ছিলেন । ঘন ঘন ম্যালেরিয়া তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। এই অসুস্থতা তার পঠন জীবনে ভয়ঙ্কর রকম প্রভাব ফেলেছিল। প্রথম বার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি তিনি, দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পাশ করেন। বহরমপুরে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ পাননি, অতঃপর কলকাতায় আসেন। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এখানে মাত্র কয়েক মাসই পড়েছিলেন। পরাক্রমশালী ইংরেজ শক্তির শোষণ ও শাসনে তখন জন্মভূমি। দেশপ্রেমের  আবাহন অস্বীকার করতে পারলেন না তারাশঙ্কর। যোগ দিলেন বিপ্লবী দলে। হাতে এলো স্বামী বিবেকানন্দ ও সখারাম গণেশ দেউস্করের বই। রাজরোষের শিকার হলেন তিনি, হলেন গৃহবন্দি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর এই বন্দিদশার ইতি হলে তিনি পুনরায় কলেজে ভর্তি হলেন, এবার সাউথ সুবারবন কলেজে। এবারো ডিগ্রি লাভ হল না তার, জন্ম সঙ্গী ম্যালেরিয়ার প্রকোপে এতটাই নাস্তানাবুঁদ হলেন যে পড়াশুনার সমাপ্তি ঘটিয়ে জন্মভিটা লাভপুরে ফিরে এলেন।

বোন কমলার ননদ উমাশশীর সঙ্গে তারাশঙ্করের বিবাহ হয়। তার বয়স তখন মাত্র সাড়ে সতেরো, উমাশশী মাত্র এগার বছর দুই মাস। তারাশঙ্করের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না, তিনি নিজেই স্বজীবনের এ পর্ব সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠল। সামান্য কলহে বা মতভেদে বিমর্ষ হয়ে কল্পনা করতে বসি- কখনো গৃহত্যাগের কল্পনা, কখনো বা অতীত সারা জীবনটাকে একেবারে উল্টেপাল্টে, নতুনভাবে বিচার করি। বার্ধক্যেও তরুণ বয়সের মতো অভিমান করে বসি। তবু মনে হয় মনের সাত মহলার কোনো গোপন মহলে কোন এক মেয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি, পাওয়া হয়নি।’ স্ত্রীর প্রতি অমনোযোগের জন্যই কী অন্য কোনো নারীর কাছে দুদণ্ডের শান্তি চেয়েছিলেন তিনি? যৌবনে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তিনজন ভারতীয় মনীষী দ্বারা প্রভাবিত হন, এই তিনজন হলেন যথাক্রমে, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমচন্দ্র। তাদের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন ন্যায়পথ, অন্যায়ের বিপক্ষে চলবার অনন্য অভিজ্ঞান। তাই জমিদারের অত্যাচার, জাতিভেদের মধ্যযুগীয় উন্মত্ততার বিরোধী ছিলেন সারাজীবন। জীবনের প্রথম ৩২টি বছর বড্ড বৈচিত্র্যময়তর মধ্যে কেটেছে তারাশঙ্করের, গ্রামের সমাজ সেবক সমিতির মুষ্টিভিক্ষাসংগ্রহক, কখনো সেবাব্রতী, গ্রাম্য পরিব্রাজক, স্বসম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক, আবার কখনো বা ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রামের উন্নয়নে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।

রাজনীতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তারাশঙ্কর। হিংসাত্মক বিপ্লবী আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি, যোগ দেন গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে। ১৯৩০ সালে সংঘটিত আইন অমান্য আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। দ্বিতীয়বারের জন্য রাজরোষের শিকার হন তিনি, ছয়মাসের জন্য আবার কারাবাসের ফরমান জারি হয়। কারামুক্ত হওয়ার পর তিনি অনুভব করেন, ‘সাহিত্য সেবার পথেই দেশ সেবা’। জেল থেকে মুক্তির পর নিজেকে গুটিয়ে নেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। ছোট ভাইয়ের হাতে তুলে দেন জমিদারীর কাজ। দেশপ্রেমমূলক বাণী প্রচার করবেন বলে একটি প্রেস স্থাপনে মনস্থির করলেন কিন্তু গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতায় তা সম্ভব হল না।  এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারাশঙ্কর লাভপুর ত্যাগ করলেন।  এতে তারাশঙ্কর যেমন বিষয়ী মুক্তি পেলেন, সেই সঙ্গে  গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজের অনেক বিধিনিষেধ থেকেও মুক্তি পেলেন। ব্যক্তিগত জীবনে নানা কষ্ট পেয়েছেন, শরীরী কষ্টের সঙ্গে তার আজীবন সংযোগ, তৎসহ সমাজিক গণ মানুষের লোভ, নানাবিধ অনৈতিক বাসনার উৎপীড়ন তাকে আহত করেছে  বারবার। প্রথম জীবনে অর্থ কষ্ট ছিল কিছুটা, তবু কোনো প্রলোভন তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। দেশের অগ্নিগর্ব সময়ে নিজেকে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো গৃহে অভ্যন্তরীণ করে রাখতে পারেনি। যোগ দিয়েছেন ১৯-এর অসহযোগ, ৩০-এর আইন অমান্যে, ৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলনেও। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, দেশবিভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ঐতিহাসিক পটভূমি, সেই সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইংরেজ পীড়ন-শাসন ও শোষণ, মহামারি ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপ, উদ্বাস্তু সমস্যার নির্মম ইতিবৃত্ত, অর্থনীতিক বিপর্যয় ও স্বাধীনতা উত্তরকালের রাজনীতিক নেতাদের নীতিবোধের পশ্চাদপদ হওয়ার আবহ তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মননকে পরিপুষ্টতা দিয়েছে।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মানস গঠনের দিক সম্পর্কে যথার্থই লিখেছেন, ‘তার সাহিত্যের দুই প্রধান উপজীব্য- মাটি আর মানুষ। মাটির মমত্ব আর মানুষের মহিমা।’ তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের দেশপ্রেম ও মমত্ববোধ  তার সাহিত্যকে দিয়েছে এক  অনন্য মহাকাব্যিক ব্যপ্তি  যা তাকে মানুষের হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখবে  অনন্তকাল ধরে।

এস ডি সুব্রত : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
হাইকোর্টের ৫২ বেঞ্চ গঠন করলেন প্রধান বিচারপতি
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft