একটি গণমাধ্যম সমাজের আয়না। গভীর জ্ঞানে সমাজের প্রতিটি বিষয় পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকের সামনে তুলে আনে গণমাধ্যম। কাজটি খুব সহজ নয়। আর এভাবে দীর্ঘ ২৭ বছর পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয়। আজ ও কালের ব্যবধানে সময়, সভ্যতা ও ইতিহাস তুলে ধরে সুনিপুণভাবে কাজটি সম্পাদন করছে দৈনিক আজকালের খবর। অবশ্যই চলার পুরো পথটি মসৃণ ছিল না।
একটি গণমাধ্যম যখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখে, তখন তার পথ যথেষ্ট বন্ধুর হয়। দীর্ঘ ২৭ বছর এমন পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে আজকালের খবর। এর আড়ালে ছিল নানা চড়াই-উৎরাই। সহজে কোনোকিছু মেলে না। আর সহজে মেলা জিনিস সব সময় থাকে না। অনেক সংগ্রাম পেরিয়ে আজকালের খবর ২৮ বছরে পা দিয়েছে। বলা চলে পূর্ণ যৌবন পেরুচ্ছে পত্রিকাটি। শৈশব ও কৈশোরের উদ্দাম সময় পেরিয়ে যৌবনের আজকালের খবর যৌবনদীপ্ত হবে। এমন আশা করতে পারি গণমাধ্যমটির অংশ হয়ে। আর পাঠক হিসেবে বলতে পারি, আরো দীপ্ত ও সাহসী হতে হবে পত্রিকাটিকে। চলার পথে আরো মসৃণ ও সমৃদ্ধ হতে হবে আজকালের খবরকে। যদি সে আজ ও কালের মোড়কে সময়-সভ্যতা-ইতিহাস ধরতে চায়। না হয় স্বভাবদুষ্ট গণমাধ্যম হয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। এমনটি অবশ্যই ১২ পাতার দৈনিকটি নয়। এমন হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কঠোর মানদণ্ড পেরিয়ে এতটা পথ আসতে পারত না পত্রিকাটি।
পথচলা দুর্গম হবে, তারপরও পথচলা থেমে যাবে না- এমন প্রত্যয় নিয়েও বলতে হয় সাংবাদিকতা খুব খারাপ সময়ে যাচ্ছে। আশাবাদী হয়েই বলতে হয়, এমন সময় ক্ষণিকের। তার জন্য থাকতে হবে সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমা।
আশাবাদীর ছলে এবার কিছু বাস্তবতা মানা চাই। বলা প্রয়োজন, একসময় সাংবাদিকতা ছিল মহৎ পেশা। মানুষ সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো। এখন মানুষ অনেক সময় সাংবাদিকদের গালি দেয়, ঘৃণা করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে করুণা ও উপহাস করে। কারণ সাংবাদিকতা এখন বেশিরভাগ দল-স্বার্থ-এজেন্ডানিষ্ঠ।
সাংবাদিকরা এখন প্রবলভাবে বিভক্ত। আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকের চোখে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের স্তুতি গাইতেই তারা বেশি উৎসাহী। প্রশংসায় ভাসাতে গিয়ে অনেক সময় ভুল উপস্থাপনাও সরকারকে যে, বিভ্রান্ত করতে পারে তা অনেক সময় ভুলে যান তারা। আবার বিএনপিপন্থি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও বর্তমান সরকারের সবকিছুই খারাপ। অনেকটা সেই প্রবাদের মতো, যখন আর সমালোচনা ও নিন্দার কিছু থাকে না তখনও বলে- ‘বেশি ভালো ভালো না’। অর্থাৎ নেতিবাচক যেমন ‘না’ শব্দটি থাকতেই হবে। সাংবাদিকতা যখন এমন, তখন তা সমাজের আয়না হয়ে উঠতে পারে না। এই বিভক্তির স্রোতে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম দৈনিক আজকালের খবর। আর সেজন্যই এতোটা পথ আসতে পেরেছে।
ব্যাক্তিগত মত, একজন সাংবাদিকের অনেক চোখ থাকবে, সব দলের ভুলত্রুটিই তার চোখে পড়বে। তার থাকবে ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, অতীত জ্ঞান ও গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি। একচোখা মানুষ, দলীয় আনুগত্যের মানুষ কখনো ভালো সাংবাদিক হতে পারেন না।
স্বপ্ন নিয়ে আশাবাদী হয়ে পথ চলতে হবে। আশা নিয়েই নৈরাশ্যের ঘটনা সামনে আনতে হবে। যেন আশারা পেখম মেলে বহুমাত্রায়; আগামীর পথ সুন্দর ও মসৃণ হয়। নৈরাশ্যের আরো কিছু খবর- গণমাধ্যমকর্মীরা এখন কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি অনিশ্চয়তায় ভোগেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সাংবাদিকদের চাকরির নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিতে ওয়েজবোর্ড চালু হলেও গুটিকয়েক পত্রিকা ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন দিয়ে থাকে। আবার অনেক পত্রিকায় একাধিক মাসের বেতন বন্ধ। যাদের একটু নাম আছে তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বেশি।
এ ছাড়া সাংবাদিকদের নানা চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। কখনো সেটা করপোরেট, কখনো বিজ্ঞাপন বা প্রভাবশালী কোনো মহলের কাছ থেকে সেই চাপ আসে। এর বাইরেও আরো একধরনের চাপ আছে, যেটা হলো সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করা। এই সেলফ সেন্সরশিপ শুরু হয়েছিল সংবাদপত্রের গোড়াপত্তনে। এ ছাড়া রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ। সবমিলে সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জের মুখে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়।
সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনকে এমন মাধ্যমকেই লড়তে হচ্ছে নানা ফ্রন্টে। মোবাইল, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। মোবাইল ফোন এখন বিশ্বের এক নম্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। সাংবাদিকদের বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে সিটিজেন জার্নালিজম। এখন সবার হাতেই স্মার্টফোন। যেকোনো ঘটনার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিলে মুহূর্তেই মানুষ জেনে যাচ্ছে। খবরটি জানার জন্য পরদিন পত্রিকার অপেক্ষা করতে হয় না।
ঠিক সেই সময়ে পাঠকের চোখের সামনে কালো ও সত্য অক্ষর হয়ে খবর আরো এগিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ খবর প্রকাশ করছে আজকালের খবর। আশা করি ছাপা গণমাধ্যমের দুঃসময় সঙ্গে করে শতবর্ষ পেরিয়ে সাফল্যের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে আজকালের খবর। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এমন ক্ষণে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রাণ জুড়ানো ভালোবাসা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
আজকালের খবর/আরইউ