বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হঠাৎ করেই নেমে এসেছে ধোঁয়াশার আবরণ। ওল্ড ডিওএইচএস ক্লাবের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালনরত তামিম ইকবালের বিরুদ্ধে জমা পড়েছিল আপত্তি, যা প্রথমেই 'রহস্যময়' তকমা পেয়েছে। অভিযোগের প্রকৃত উৎসই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যখন সাবেক ক্রিকেটার হালিম শাহ নিজে দাবি করেন-তিনি কোনো লিখিত আপত্তি দেননি। এখানেই তৈরি হয় নাটকীয় এক বাঁক।অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন ন্যূনতম আস্থাও রাখেনি। কারণ, শুনানিতে আপত্তিকারী অনুপস্থিত থাকায় কমিশন সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছে-তামিমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে তারা 'আমলযোগ্য' মনে করছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ হোসেইন গতকাল বলেছেন, 'আমরা চিঠি পেয়েছি, তবে শুনানিতে যিনি উপস্থিত নন, তার বক্তব্য আর গুরুত্ব পায় না।'
এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আরেকটি কেন্দ্রীয় ইস্যু হলো বিতর্কিত ১৫ ক্লাব। দুদকের পর্যবেক্ষণের কারণে খসড়া ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তৃতীয় বিভাগের বাছাই থেকে উঠে আসা এ ক্লাবগুলো। তার মধ্যে ভাইকিংস ক্রিকেট একাডেমির প্রতিনিধি ইফতেখার রহমান মিঠু প্রশ্ন তুলেছেন- বোর্ড সভার অনুমোদন ছাড়াই কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? এমনকি কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষরে কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তাও নির্বাচন কমিশন জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই বাদ দেওয়া সিদ্ধান্তের নেপথ্যে গোপন চাপ বা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
তামিম ইকবাল নিজেও সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, চাপ তার ওপর যথেষ্ট আছে, এমনকি তার কাউন্সিলরশিপও বাতিল হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন হঠাৎ করে ১৫টি ক্লাবকে বাদ দেওয়া হলো, অথচ এতদিন ধরে তাদের নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? তামিমের মতে, এখানে মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে এক পক্ষকে দুর্বল করা। তার ভাষায়, 'এত খারাপ সময় এসে গেল যে ৩০০ ক্রিকেটারের জীবনের সঙ্গে খেলায় মেতেছেন কেবল ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য।'
তামিম আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন-'সাবেক ক্রিকেটার' বলতে আসলে কাকে বোঝায়? তিনি গত পাঁচ মাসে কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেননি, অথচ তাকে সাবেক ধরা হবে না কেন? মোহাম্মদ আশরাফুল কিংবা আমিনুল ইসলাম বুলবুল কেউ আনুষ্ঠানিক অবসরের ঘোষণা দেননি, তবুও তাদের তালিকায় জায়গা হয়েছে। এই বৈপরীত্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতাকে আরও প্রকট করে তোলে। তামিম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে এভাবে 'নোংরামি' চালিয়ে যাওয়া হলে তা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার অনুরোধ-'হার-জিত বড় কথা নয়, কিন্তু কেবল ইগো বা জয়লাভের নেশায় নির্বাচনকে কলুষিত করবেন না।' এমনকি তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তার পক্ষ হয়ে কারো কথা বলার প্রয়োজন নেই, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করাই যথেষ্ট।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন, তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। এবার প্রথমবার বিসিবির বাইরের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং, প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়াও তাদের কাছে স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু সংবাদমাধ্যম ও অংশীজনের মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে-এই স্বাধীনতা কতটা বাস্তব, আর কতটা শুধুই প্রদর্শনমূলক?
বিসিবির নির্বাচন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতি নিছক ক্রীড়া প্রশাসনের প্রতিযোগিতা নয়, এটি এক বৃহত্তর নৈতিকতার প্রশ্ন। রহস্যময় অভিযোগ থেকে শুরু করে ক্লাব বাদ দেওয়া, সাবেক ক্রিকেটার সংজ্ঞার অস্পষ্টতা কিংবা কমিশনের স্বাধীনতা-সব মিলিয়ে গোটা চিত্রে ফুটে উঠছে এক ধরনের অস্বচ্ছ রাজনীতি। তামিম ইকবালের বক্তব্য সেই অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেবল কিছু ইচ্ছা পূরণ কিংবা ক্ষমতার পাল্লা ভারী করার জন্য কি ৩০০ ক্রিকেটারের জীবন-জীবিকা নিয়ে খেলা হবে? উত্তর আপাতত ঝুলে আছে আগামী ৬ অক্টোবরের নির্বাচনের দিকে।
গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ হোসেইন জানিয়েছেন, খসড়া ভোটার তালিকার ওপর মোট ৩৮টি আপত্তি পেয়েছিলেন তারা। যার ৩০টি জমা দেওয়া হয়েছে সশরীর ও আটটি ই-মেইলে। আপত্তির ওপর হওয়া শুনানিতে গতকাল আট জন অনুপস্থিত ছিলেন। আজ বিকাল সাড়ে চারটায় চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, 'অনুগ্রহ করে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, হয়তো ভালো কিছুই দেখবেন।'
আজকালের খবর/ এমকে