
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিয়ে যখন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা চলছে, তখন একটি অদৃশ্য হাত বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হলো তামাক শিল্প। এ হাতটি শুধুই একটি ব্যবসায়িক সত্তা নয়, এটি এমন এক শক্তি, যা সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলার জন্য বহু কৌশল ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৪৪২ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে প্রাণ হারান। তামাকের ব্যবহারে পঙ্গুত্ববরণ করে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৭ কোটি ৬২ লাখ মানুষ। যা আমাদের উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা।তামাকের ভয়াবহতা হ্রাসে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-তে স্বাক্ষর করে।এরপর ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৩ সালে তা সংশোধন করে ২০১৫ সালে এই আইনের বিধিমালা পাস হয়। তবে এটি আরো যুগোপযোগী করতে তামাক নিয়ন্ত্রন আইন শক্তিশালী করা অতি জরুরি।
বর্তমানে ‘ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস’ যেমন ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদি কিশোর ও তরুণদের মাঝে ক্রমবর্ধমানভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এর উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের মাধ্যমে।এদিকে,২০২৩ গ্লোবাল টোব্যাকো কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনকভাবে কম রয়েছে, যা প্রমাণ করে এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য নীতিতে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধে বাংলাদেশ তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
আমরা এখনো বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক পণ্যের প্রদর্শনী দেখতে পাই। মুদি দোকান, চায়ের স্টল বা সুপার শপে প্রায়শই দেখা যায় সিগারেট, বিড়ি কিংবা অন্যান্য তামাক দ্রব্য সাজিয়ে রাখা হচ্ছে এমনভাবে, যা ক্রেতার দৃষ্টিগোচর হয় সহজেই। এটি নিছক পণ্য প্রদর্শন নয়—এ এক প্রকারের বিজ্ঞাপন। আর এই বিজ্ঞাপন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কিশোর ও তরুণদের ওপর।এসব বিজ্ঞাপন দেখার ফলে তারা কৌতুহল বসত শুরু করে এবং পরবর্তীতে তারা আষক্ত হয়ে পড়ে।এতে লাভবান হয় কোম্পানি কারণ তারা দীর্ঘ মেয়াদী ভোক্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
FCTC আর্টিকেল ৫.৩ সুস্পষ্টভাবে বলেছে: "তামাক শিল্পের প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য নীতিকে রক্ষা করতে হবে।" অর্থাৎ, নীতিনির্ধারণে তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।সম্প্রতি আমরা এই ধারার ব্যত্যয় দেখতে পেয়েছি।এছাড়া বিভিন্ন CSR কার্যক্রম, মিটিং, কনফারেন্স বা সরকারের কোনো প্রকল্পে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো নিজেরাই নিজেদের “উন্নয়ন সহযোগী” হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ, এই শিল্প প্রতিবছর লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে শক্তিশালী করতে সরকার যখন উদ্যোগ নেয়, তখন নানা ধরনের প্রভাব ও চাপে তা বিলম্বিত হয় বা দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও নানা ধরনের ‘ব্র্যান্ড প্রোমোশন’ অব্যাহত রয়েছে। আর এসবের পেছনে শিল্পের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশ ২০০৩ সালে FCTC-এর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সাক্ষর করে।অথচ এখনো ৫.৩-এর নীতিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে তামাক কোম্পানিসমূহের অপচেষ্টা প্রতিহিত করে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে প্রনীত আইন শক্তিশালী করা অতি জরুরি।তাহলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটি তামাক মুক্ত সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে সক্ষম হবো।
আজকালের খবর/বিএস