
নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগারের একক সেলে রাখা হলো আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে সরাসরি সেই নতুন সেলে নেয়া হয়।
এর আগে দুপুরে নিজের দোষ স্বীকার করে নিজেকে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন ট্রাইব্যুনালে। সেখানে তিনি বলেন তিনি জুলাই হত্যায় অপরাধবোধ করছেন। তিনি সব খুলে বলতে চান। এজন্যই তিনি সাক্ষী হতে চান। পরে তার আইনজীবী ট্রাইব্যুনালকে বলেন, তিনি যেহেতু অন্য বন্দিদের সঙ্গে থাকেন সেখানে তার নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। কাজেই তাকে অন্য সেলে রাখা হোক। পরে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল ১ চৌধুরী মামুনের নিরাপত্তা বাড়াতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তাকে ভিন্ন সেলে নিরাপত্তা দিতে বলা হয়।
বহুকাল থেকেই অপরাধ জগৎ বড় বিচিত্র। অপরাধীকে খুঁজে বের করা পুলিশের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অপির্ত। কিন্তু কখনো কখনো অপরাধের রহস্য উদঘাটন করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধৃত আসামি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তখন পুলিশ অপরাধীকে মুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে সত্য ঘটনা বলার জন্য সাক্ষী করার প্রস্তাব দেয়। আসামি রাজি হলে তাকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী করা হয়।
সুতরাং বলা যায় ‘রাজসাক্ষী’ মানে রাজ্যের সাক্ষী। যেহেতু সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় রাজার ‘রাজ্য প্রথা’ ছিল, সেহেতু এ ধরনের সাক্ষীকে ‘রাজসাক্ষী’ বলা হতো। এখন রাজাও নেই রাজত্ব প্রথাও নেই। তাই রাজসাক্ষীকে বতর্মানে ‘রাষ্ট্রের সাক্ষী’ বলা হয়। যাকে ‘রাজসাক্ষী’ করা হয় তার বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য নিরপেক্ষ সমথর্নযোগ্য সাক্ষীও থাকে।
সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, যে অপরাধী, প্ররোচক বা জড়িত হিসেবে অপরাধের বিষয়ে বা প্রত্যেকসহ অপরাধীর (Accomplice) বিষয়ে তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সকল ঘটনার সম্পূর্ণ ও সত্য বিবরণ প্রকাশ করবে, এই শর্তে তাকে বিচারক ক্ষমার প্রস্তাব দিতে পারেন। ফৌজদারী মামলাতে এই সুযোগপ্রাপ্ত অপরাধীকে রাজসাক্ষী (Approver) বলা হয়। যদিও সাক্ষ্য আইনে রাজসাক্ষী কথাটি সংজ্ঞায়িত করা নেই।
কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয় যাতে অন্য কোনো অপরাধী বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কমের্র সহযোগীর অসমথির্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। এ ধারা মতে আসামিকে যিনি রাজসাক্ষী হবেন তাকে ক্ষমা প্রদশের্নর ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আসামি সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা সে অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। কাজেই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণে আদালত বেশ সতকর্তা অবলম্বন করেন। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
অপরাধ দমনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর একারণে অধিকাংশ অপরাধের মামলার বাদী রাষ্ট্র হয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্রিটিশ শাসনামলে বাদী হতেন রাজা। তাই গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি যারা আইনের সুযোগ নিয়ে সাক্ষী হয়ে রাজার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করতেন তারাই ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে গণ্য হতেন। কোনো একটি অপরাধ সংঘটনে যে সব ব্যক্তি জড়িত থাকে তাদের প্রত্যেককে অপরাধের সহযোগী বলা চলে।
অপরাধে সহযোগী সাধারণত সরকার থেকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি লাভ করে রাজসাক্ষীতে পরিণত হয় এবং সে কারণে সরকারের পক্ষাশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাক্ষ্যের অভাবে কোনো অপরাধী যাতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি না পায় সে কারণে ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষে আসামিকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারীর কোনো সহচর যদি অপরাধের ঘটনা সম্পূণর্ভাবে প্রকাশ করে এবং নিজেকে জড়িয়ে সহচরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ বলে।
কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা দশ বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দন্ডণীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ২১১ ধারার অধীনে সাত বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা দন্ডবিধির ধারা ২১৬ক, ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ ও ৪৭৭ক-এর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটির তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে অপরাধের সহযোগী কোনো ব্যক্তিকে এই শর্তের ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে অপরাধীদের সম্পকের্ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগত বিষয়ে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা যাবে। রাজসাক্ষীর দেয়া তথ্য পরবর্তীতে যদি অসত্য প্রতিপন্ন হয়, সেক্ষেত্রে সে ক্ষমা পাবে না।
রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি উপাদান থাকতে হবে যথা ক) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খ) অন্য সব আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূণর্ বিষয় দ্বারা সমথির্ত। রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকে তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুবর্ল। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নিভর্র করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে আদালত সবোর্চ্চ সতকর্তা অবলম্বন করে এবং সাবির্কভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।
আজকালের খবর/বিএস