রাজশাহী মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীকে কুপিয়ে আহত ও ছেলেকে হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। ওই ঘটনায় দেশের সব আদালত, বিচারকের বাসস্থান ও যাতায়াতের সময় অবিলম্বে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্তসহ দুটি দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। দাবি আদায়ে ৪৮ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অন্যথায়, সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে কলম বিরতি পালনের অংশ হিসেবে বিচারকরা আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন না বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বেলা আড়াইটার দিকে রাজশাহী মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে তার ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসীকে (৪৪) কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ঘটনায় লিমন মিয়া (৩৫) নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে ওই ঘটনার পর ‘নিরাপত্তাহীনতায় বিচার বিভাগ: শোকসন্তপ্ত বিচারকদের তীব্র প্রতিবাদ’ শিরোনামে শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) একটি বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের সই করা বিবৃতিতে দুটি দাবি উত্থাপন করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গভীর শোক ও ক্ষোভের সঙ্গে প্রকাশ করছে যে, গত ১৩ নভেম্বর বিকাল ৪টায় রাজশাহীর বিজ্ঞ মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের (জেলা জজ) বাসভবনে দুর্বৃত্তের নৃশংস ছুরিকাঘাতে তার ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন (১৭) নিহত এবং স্ত্রী তাসমিন নাহার গুরুতর আহত হয়েছেন। অ্যাসোসিয়েশন এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার তাওসিফ রহমান সুমনের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। প্রকাশ্য দিবালোকে বিচারক পরিবারে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো বিচার বিভাগ আজ স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ! আমরা আরও গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে ন্যক্কারজনক এ ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই গ্রেফতারকৃত আসামিকে আদালতে সোপর্দ করার পূর্বেই বিধিবহির্ভূতভাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।’’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা দেশের বিচারকরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। দেশের প্রত্যেক আদালত/ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ, এজলাস, বিচারকদের বাসভবন ও গাড়িতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বারবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও সরকার কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিচার বিভাগের সদস্যরা রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও তারা ও তাদের পরিবার অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন। জেলা পর্যায়ের সব বিচারকের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি আবাসন ও পরিবহন ব্যবস্থা নেই। চৌকি আদালতে কর্মরত বিচারকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ফলে বিচারকদের বাধ্য হয়ে অরক্ষিত বাসায় ভাড়া থাকতে হয়, রিকশা-ভ্যানে করে এমনকি পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করতে হয়। এই দৃশ্য দেখার যেন কেউ নেই! বিচার বিভাগের প্রতি এই উদাসীনতা ও চরম গাফিলতির বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা সোচ্চার থাকলেও রাষ্ট্র কোনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি— যার পরিণতিতে আজ বিচারক পরিবারে এ করুণ বিপর্যয় নেমে আসে। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় বিচারকরা সর্বদা নিয়োজিত থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই রক্তের দায় কোনোভাবে এড়ানোর সুযোগ নেই।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিচারকদের কর্মের পরিবেশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের কাছে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য দুটি দাবি উপস্থাপন করছে—১. সব আদালত, বিচারকের বাসস্থান ও যাতায়াতের সময় অবিলম্বে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্ত করতে হবে। ২. রাজশাহীর ঘটনায় বিচারকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবহেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং গ্রেফতারকৃত আসামিকে আইনবহির্ভূতভাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে অপেশাদারত্ব প্রদর্শনের দায়ে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিবৃতিতে আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হয়েছে—আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই দাবি বাস্তবায়নপূর্বক বিচারকদের কর্মের পরিবেশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে আগামী রবিবার (১৬ নভেম্বর) থেকে সারা দেশের বিচারকরা একযোগে কলম বিরতি পালন করবেন। সেইসঙ্গে বিচারক পরিবারের নিহত সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের সব বিচারক নিজ নিজ কর্মস্থলে আগামী রবিবার (১৬ নভেম্বর) কালো ব্যাজ ধারণ করবেন।
অ্যাসোসিয়েশনের এই ‘কলম বিরতির’ মানে হলো—ওইদিন থেকে অধস্তন আদালত তাদের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা থেকে বিরত থাকবেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘কলম বিরতির মানে হলো আমরা কোর্টে বসবো না। অর্থাৎ দাবি আদায় না হলে কোর্টে বিচারকদের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘দেশে বিচারকদের কলম বিরতির ঘোষণা এটিই প্রথম। আমরা ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের দাবি আদায় না হলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।’’
এদিকে ওই নৃশংস ঘটনার পর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। প্রধান বিচারপতির শোক প্রকাশের পাশাপাশি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়—‘‘প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় সুপ্রিম কোর্ট এ ঘটনা সংশ্লিষ্ট সব অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং দ্রুততার সঙ্গে একটি যথাযথ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার যথাযথ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছে, যাতে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত হয় এবং দোষীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়।’’
এর আগে গত ২৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি দেশের আদালতগুলোতে ও বিচারকদের বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
এছাড়া ওই ঘটনার পরপরই আইন উপদেষ্টা সব অপরাধীকে গ্রেফতার ও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানায় আইন মন্ত্রণালয়।
আজকালের খবর/ এমকে