ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ৭ টি রাজনৈতিক দল ও একটি সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে রোববার তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈঠকগুলোতে শীর্ষ রাজনীতিকদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন সরকার প্রধান।
তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। রোববার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে পৃথক বৈঠকে এই বার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এ বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ কথা জানিয়ে আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা করেছেন, নির্বাচন সেই সময়ের মধ্যেই হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা নির্বাচন হবে।
বৈঠকগুলোতে জাতীয় পার্টির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, জাতীয় পার্টির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। একেকটি দল একেক ধরনের মতামত দিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা সেটা শুনেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের কথা হচ্ছে। এ বিষয়ে কমিশন গণমাধ্যমকে জানাবে।
বৈঠকগুলোতে জাতীয় পার্টির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, জাতীয় পার্টির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। একেকটি দল একেক ধরনের মতামত দিয়েছে, চিফ অ্যাডভাইজার (প্রধান উপদেষ্টা) সেটা শুনেছেন। এর আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এসব বৈঠকে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তবে সব বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টারা সবাই উপস্থিত ছিলেন না।
একটি শক্তি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে, তবে পেছানোর সুযোগ নেই-বিএনপি : সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করে বিএনপির প্রতিনিধিদল। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন। বিএনপি আশা রাখে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন হবে। জাতীয় পার্টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান মির্জা ফখরুল।
লন্ডনে একটি দলের প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ প্রমাণ করে সরকার একটি দলের ওপর দুর্বল-জামায়াতের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, এটি একেবারেই অমূলক দাবি। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, করতেই পারেন। তার এখতিয়ার আছে যে কোনো দলের প্রধানের সঙ্গে বসার। এটা একান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার বিষয়ে বিএনপি মতামত দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও উদ্বেগজনক। এটা ভালোভাবে তদন্ত হওয়া দরকার।
মির্জা ফখরুল বলেন, একটি শক্তি নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তবে নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের তারিখ হিসাবে যেটা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেই তারিখেই নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।
সরকার কীভাবে নির্বাচন করবে-শঙ্কিত জামায়াত, জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি : জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ। বিকাল সোয়া ৪টায় জামায়াতের প্রতিনিধি দলটি যমুনায় প্রবেশ করে। ১ ঘণ্টার বৈঠক শেষে সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অবাধ নির্বাচন হবে বলেছেন। আমরা তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছি। কিন্তু কার্যকারিতার বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। লন্ডনে গিয়ে নির্বাচনের সময় ঘোষণার ঘটনায় নিরপেক্ষতার প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণা সব দলের সঙ্গে আলোচনায় হয়নি। এতে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়নি। নির্বাচনের সময় ঘোষণা মনে হচ্ছে চাপে পড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল জুলাই সনদের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার পর নির্বাচন ঘোষণা করা।
নির্বাচনের সময় নিয়ে দ্বিমত নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচনের সময় নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু জুলাই চার্টার হতে হবে। এটা অর্জন না করে নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে দেওয়া অন্যরকম ব্যাপার হয়েছে। একটা দল যেভাবে চেয়েছে সেভাবে হয়েছে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্ট বলে আসছি, আমরা চার্টারের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই এবং এই চার্টারের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হতে হবে। জুলাই চার্টারের আইনগত ভিত্তির ব্যাপারে আমরা খুব পরিষ্কার বলে আসছি, সেটা হচ্ছে গণভোট।
জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, নুরুল হকের (গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি) ওপর হামলার ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বলেছে জামায়াত। আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সহযোগী হিসাবে জাতীয় পার্টি কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, জাতীয় পার্টির বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন তারা। তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা বলেছি আগে একদল বাসস্ট্যান্ড দখলে নিত, এখন আরেকটি গ্রুপ নিয়েছে। সরকারকে দখলদারদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। যে সরকার এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সেই সরকার কীভাবে নির্বাচন করবে আমরা তা নিয়ে শঙ্কিত। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশ নৈরাজ্যের দিকে চলে যাবে। কোনো নীলনকশা বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে না। এই সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, যেসব ফ্যাসিবাদের দালাল এখনো প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায়, বহু সিভিলিয়ান, পুলিশে আছে, তাদের অবিলম্বে সরাতে হবে। নিরপেক্ষ লোকদেরই সে প্রশাসনে নিয়ে আসতে হবে।
গণপরিষদ নির্বাচন চায় এনসিপি, জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের পক্ষে : বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করে এনসিপির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। ১ ঘণ্টার বৈঠক শেষে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী যে নির্বাচনটি হবে, সে নির্বাচনটি যেন অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হয় এবং সে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘ ৫৫ বা ৫৪ বছরের যে সংকট, যে একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব কিংবা কাঠামো গড়ে উঠছে, সেটার স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা মনে করি আগামী নির্বাচনটি গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হয়নি। সরকারের কাছে শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তারা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সমর্থনে মিছিল করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এখনো আটক থাকা ব্যক্তিদের দেশে ফেরাতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে এনসিপি। এ ছাড়া গুম কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় যেসব সংস্থার সদস্যরা এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের বিষয়ে যেন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সে বিষয়েও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন এনসিপির নেতারা।
নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা এবং নিরপেক্ষতার বিষয়ে যেন প্রধান উপদেষ্টা ভূমিকা রাখেন, সে বিষয়েও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা। এ প্রসঙ্গে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে এবং আমরা দেখতে পাই, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার জন্য একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের বিষয়ে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। সেজন্য জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম যেন স্থগিত করার বিষয়ে সরকার আরও বেশি কার্যকর হয়, সে বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে আমলে নেওয়ার জন্য বলেছি।’
আজকালের খবর/ এমকে