ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন চলছে পুরোমাত্রায়। দেশ আজ নির্বাচনের মহাসড়কে, রাজনৈতিক দল ও তাদের মনোনীত প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রচারণায়। বহু বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারা সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক উৎসাহ। তারা অপেক্ষা করছেন একটি উৎসবমুখর, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। শান্তিপূর্ণ সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে এটাই এখন জাতির প্রত্যাশা।
কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গণভোট ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে দেখা দিয়েছে দ্বিধা ও অবিশ্বাস। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এই সংকট আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ রাখছে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও সবসময় সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। রাজনৈতিক বিভক্তি নতুন নতুন জটিলতার জন্ম দিচ্ছে। তফসিল ঘোষণার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলেছেন যে খেলাই হোক, যে ষড়যন্ত্রই হোক, নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের আর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি জানেন গণতন্ত্রের ভিত্তিই নাগরিকের ভোটাধিকার। তাই নির্বাচনকে তিনি দেখেন ‘টিম ওয়ার্ক’ হিসেবে এবং এই টিম স্পিরিটকে সফল করতে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন। মিরপুর সেনানিবাসে ডিএসসিএসসি কোর্স-২০২৫ এর সমাপনীতে এবং পরে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হবে। নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
নির্বাচন সামনে রেখে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সেনাপ্রধান জানিয়েছেন—সেনাবাহিনী যথাযথভাবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে, যেন একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়। নৌবাহিনী প্রধানও একই অঙ্গীকার করেছেন—সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী দেশের সংকটময় মুহূর্তে সবসময় জাতির পাশে থেকেছে, নির্বাচনেও থাকবে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রতিটি সংকটে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছাত্র-জনতা -সামরিক বাহিনীর অভূতপূর্ব ঐক্যে দেশ যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে, তাতে তিন বাহিনীর দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও নেতৃত্ব ছিল মুখ্য। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এ পথচলায় তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। সামনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতেও সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকেও তা স্পষ্ট।
দেশে যখনই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল মুখ্য। একটি স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গত ১৫ মাসের অভিজ্ঞতা তা প্রমাণ করেছে। সাধারণ মানুষের আস্থাও সশস্ত্র বাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেই কারণেই নির্বাচন নিরাপদ করতে সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা সম্প্রসারণ করে ২০২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠে রাখছে।
২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অংশ ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে ওই সংজ্ঞা থেকে তাদের বাদ দেওয়ায় তিনটি নির্বাচনই বিতর্কিত হয়। এবার অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী আইন সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মর্যাদা দিয়েছে—ফলে তারা ভোটকেন্দ্রে আটকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পূর্ণ ক্ষমতা পেয়েছে। এতে ভোট কারচুপি ও সহিংসতা কার্যকরভাবে প্রতিরোধের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এর মধ্যেও রাজনৈতিক অঙ্গণে এখনও অবিশ্বাস কাটেনি। রাজধানীসহ সারাদেশে সহিংসতা, উত্তেজনা ও খুন-খারাবির ঘটনা রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, সুশাসন নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন—এসবই এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে।
এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহনশীলতা, আস্থার সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং সংঘাত পরিহার আজ সময়ের অনিবার্য দাবি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে—গণতন্ত্র মানেই একসঙ্গে পথচলা। তাই গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানসূত্র মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তা না হলে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে এবং রাষ্ট্র ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই পারে দেশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বের করে আনতে, গণতন্ত্রকে সংহত করতে এবং জাতীয় অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে। নির্বাচন বানচাল করতে সক্রিয় অপশক্তি ও পেশিশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যই একমাত্র প্রতিরোধ। সবাই একসঙ্গে দাঁড়াতে পারলেই টেকসই গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হবে—কুয়াশা সরিয়ে উঁকি দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আলোয় ভরা এই দেশে আবারও হাসবে মানুষ—বিজয়ী হবে একাত্তর ও চব্বিশের বাংলাদেশ।