গত কয়েক মাসে কবি আল মাহমুদ মৃত্তিকা ফুঁড়ে নতুন করে দৃশ্যমান হয়েছেন আমাদের আকাশে। তাকে দেওয়া হয়েছে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা পদক। বাংলা একাডেমি এবং একুশে পদক পাওয়া হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তার সাহিত্য নিয়ে বাংলা একাডেমিও সেমিনারের আয়োজন করেছে। বিপুল মানুষের মোনাজাত ও পদভারে তার সমাধি এখন মুখর। রাজধানী থেকে মৌড়াইলের দূরত্ব এক লহমায় ঘুচিয়েছেন তিনি। মৃত আল মাহমুদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছেন, চর্চা বেড়েছে তার।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি হিসেবে বিবেচিত হন একাধিক কারণে। তার কবিতায় ভাষার শক্তি, চিন্তার গভীরতা, দেশজ অনুভব, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মানবিক বোধের সংমিশ্রণ তাকে একজন ‘বড় কবি’ করে তুলেছে। আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় গ্রামীণ ও লোকজ শব্দ, উপমা এবং রূপক ব্যবহার করে এক নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি করেছেন। তিনি শহুরে কাব্যধারার বাইরে গিয়ে বাংলা কবিতাকে এক গভীর মাটির ঘ্রাণ দিয়েছেন। উদাহরণ- ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে,/চুল খোলা আয়েশা আক্তার।’ এই ধরনের পঙক্তিতে আবহমান গ্রামবাংলার চিত্র ও লোকায়ত ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
আল মাহমুদের কবিতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা স্পষ্ট। তিনি পূর্ববাংলার স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এবং গণমানুষের বেদনা তার কবিতায় স্থান দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কবিতা ‘ক্যামোফ্লেজ’ বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। ‘বোশেখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা অনবদ্য। অন্য এক কবিতায় মুজিবকে নিয়ে লিখেছেন- ‘‘সে যখন ডাকলো ‘ভাইয়েরা আমার।’/ভেঙে যাওয়া পাখির ডাক নেমে এলো পৃথিবীর ডাঙায়।’ ভাসানীকে এঁকেছেন অতিপ্রাকৃত উপমায়- ‘মওলানার টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি যেন/এক হারিয়ে যাওয়া পর্বতের স্মৃতি।’ তার কবিতায় অন্য শতকের অগ্রজ কবি মুকুন্দরাম এবং আলাওলও ঠাঁই পেয়েছেন পরম ভালোবাসায়। অন্যত্র লিখেছেন- ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ছিল বুঝি আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়’ [অধ্যয়ন, লোক লোকান্তর]।
তার শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি ‘সোনালি কাবিন’; যেখানে প্রেম, সমাজ, ধর্ম ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব একসাথে উঠে এসেছে। তবে ‘কালের কলস’-এর একটি কবিতায় নারীর বেদনার্ত ছবিও এঁকেছেন কবিÑ ‘আমিও যখন এসেছি নগরে এ কি!/তোমার শরীরে আভরণ নেই কোনো/পশুর থাবায় বিঁধে আছে চেয়ে দেখি/নাভিমূল আর কামনার অঙ্গনও।’ [হে আচ্ছন্ন নগরী, কালের কলস]
তিনি লোক-বাংলা এবং ইসলামি ভাবধারাকে আধুনিক চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন, যা খুব কম কবিই করতে পেরেছেন। এটি তাকে স্বতন্ত্র উচ্চতা দান করেছে। প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করতে করতে একসময় তিনি হয়ে উঠেছেন গোটা দেশের কণ্ঠস্বর।
আল মাহমুদের কবিতা ছন্দ, শব্দের দ্যোতনা ও চিত্রকল্পের কারণে সংগীতধর্মী হয়ে ওঠে। তার কবিতা শুধু পাঠে নয়, শ্রবণেও এক রকম আনন্দ দেয়। ‘যদি যান কাউতলি রেলব্রিজ পেরিয়ে ভাদুঘর গ্রাম’ কিংবা ‘বিষাদগীতি গাইছে বসে তিতুমীরের কন্যা’Ñ এ ধরনের লিরিক্যাল পঙক্তি তিনি অযুত বার সৃষ্টি করেছেন।
ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখলেও তিনি প্রধানত একজন কবি। কবি শামসুর রাহমানকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘আল মাহমুদের কোন সৃষ্টি আপনার প্রায়শ পড়তে ইচ্ছে করে।’ এক মুহূর্ত না ভেবে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিতুলনা। এটি অতিমানবীয় রচনা।’
আল মাহমুদ সন্দেহাতীতভাবে অনেক বড় কবি, কারণ তিনি বাংলা কবিতাকে একটি নতুন ভাষা, শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। তার কবিতা শুধু সাহিত্য নয়; ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক জীবন্ত দলিল। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের অন্যতম সাংস্কৃতিক মানচিত্র। তাই আল মাহমুদকে পড়তে হয়, তা না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
আজকালের খবর/আরইউ