শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংকট ও সম্ভাবনা
মোছা. জেসমিন আক্তার
প্রকাশ: সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫, ৩:৪৬ PM
শিক্ষা মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রধান স্তম্ভও বটে। আমরা কখনো আনুষ্ঠানিক, আবার কখনো অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করি। এই শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পৃথিবীব্যাপী গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা। শিক্ষার এই ধারাবাহিক পথ পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়; এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। আর এদিক থেকে, আমি মনে করি বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই পাঠদানের স্থান নয়, বরং এটি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এমনকি একটি শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা একটি দেশকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের এই মূল্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ অবহেলার শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে ৫৭টি পাবলিক, ১১৫টি প্রাইভেট ও ৩টি আন্তর্জাতিকসহ সবমিলিয়ে ১৭৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেখে আনন্দিত হলেও, এসবের মান নিয়ে রয়েছে চরম হতাশা।শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদরাসা, কারিগরি, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, শিক্ষার সঙ্গে কর্মের দূরত্ব, ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা, শিক্ষা বাজেটের অপ্রতুলতা, শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতির বিস্তার, বুলিংসহ যৌনহয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টারের প্রাধান্য, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ইত্যাদি বিষয় বহুলাংশে দায়ী। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন অনুসারে, একটি দেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬ শতাংশ। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা থাকলেও গত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো শ্রেণিকক্ষের সংকট। শিক্ষার্থী সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও সেই তুলনায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ভিড়ে পড়াশোনার পরিবেশ ব্যাহত হয়। একটি কক্ষে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী থাকায় পাঠদানের কার্যকারিতা কমে যায় এবং শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এক জন করে শিক্ষক থাকতে হবে। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ এর দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে বর্তমান শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত সরকারি কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারি কলেজসহ শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার।যার গড় অনুপাত হয় প্রায় ১:৩১২। শিক্ষা পরিসংখ্যান -২০২১ এর মতে,বাংলাদেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৬০ টি, যার ৫০ টি সরকারি, ১০৮টি বেসরকারি ও ২ টি আন্তর্জাতিক। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৩৩৫২৯ এবং শিক্ষক সংখ্যা ৩০৯৭৬, যার শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত প্রায় ১:৪০। আর শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনুপাত ১:৫৮।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে সেখানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭০১৮ এবং শিক্ষক সংখ্যা ১৯৯২। যার গড় অনুপাত ১:১৮ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এ অনুপাত ঠিক থাকলেও সকল বিভাগে  এ অনুপাত রক্ষা করা হয়নি। ব্যাবসায় শিক্ষা অনুষদের একাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমে, মার্কেটিং, ফিন্যান্স বিভাগের এ অনুপাত ১:২৫,  ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ১:৩৩। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এ অনুপাত প্রায় ১:৪২। এছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই বললেই চলে। অন্যদিকে,আমেরিকার এক শিক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০২২ সালের সেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৫। যেখানে MIT ও University of California এর অনুপাত ১:৩।

দেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণার অন্যতম প্রধান বাধা প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ। প্রত্যন্ত বাংলাদেশে মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকমাত্রই ‘প্রফেস্যার’ হিসেবে লোকমুখে সমাদৃত। শিক্ষকেরাও এমন পরিচয় দিতে বা পেতে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে গৌরব বোধ করেন, যার আদতে ভিত্তিমূলক কোনো মেরিটই নেই! কিন্তু প্রকৃতার্থেই যারা ‘অধ্যাপক’ পদে আসীন হয়েছেন, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারা কি এই গুরুভার বহনের যোগ্য? তারা কি আদতেই প্রবক্তা হয়ে ওঠেন? বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার নয়া-বয়ান নেই। নেই স্বায়ত্তশাসনের নির্বাহী-রূপ, যার সঙ্গে তাত্ত্বিকভাবেই প্রবক্তা সত্তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। বরং নির্বাহী-দাসত্বের বদৌলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে ‘সরকারদলীয় শাখা কার্যালয়ে’ পরিণত হয়েছে। এসবের দায়ভার এই তথাকথিত অধ্যাপকদেরই, যারা প্রবক্তা হওয়া তো দূরের কথা, শিক্ষক হওয়ারই যোগ্য নন সিংহভাগ! বাজারব্যবস্থার দাসস্বরূপ এ পেশাটিকে ‘শিক্ষকতা’ নয়, তারা ‘চাকরি’  হিসেবেই নিয়েছেন। এরপর কেউ হয়েছেন ভোটার, কেউ দলদাস সভাসদ-প্রার্থী, কেউ দলীয় তাঁবেদার অযোগ্য উপাচার্যসহ বিবিধ ক্ষমতালিপ্সু পার্ষদ। এভাবেই ভোটাভুটি ও দলবাজির আনন্দে আস্ত একটা ‘শিক্ষকতা’ জীবন পার করেন তাঁরা।ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে কয়েক ধাপে পদোত্তীর্ণ হয়ে তারা অধ্যাপকের ‘বাংলাদেশি সংস্করণ’হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সিংহভাগই আর প্রবক্তা হননি। তাদের ‘প্রফেস্যার’  বলবেন? বলবেন গবেষক!

এ প্রসঙ্গে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য শর্ত ছিল পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। কিন্তু সত্যেন বোস তখন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে গবেষণায় মত্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল সব হিসাব -নিকাশ নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপ্তি দিলে তার বন্ধু মেঘনাদ সাহা তাকে এ পদে আবেদন করতে বলেন। জনাব বোস তখন তার পিএইচডি ডিগ্রি নেই বলে তিনি আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানান তৎকালীন নিয়মানুযায়ী, যদিও পরে আইনস্টাইনের রেফারেন্সে তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন। আর বিগত সরকারের আমলে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপক তো বটেই হয়েছিলেন উপাচার্য এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ইউজিসির চেয়ারম্যানও।

বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা জ্ঞান সৃষ্টির আধার হিসেবে গণ্য করি, সেখানে উপযুক্ত গবেষণা থাকতেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যতটা আগ্রহী, গবেষণার বিষয়ে ততটাই অনাগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বরাতে জানা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ ২০২২ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এত কম বরাদ্দ রেখেছে, তা দিয়ে কোনো মানসম্পন্ন গবেষণাও সম্ভব নয়।এর আগের বছরের প্রতিবেদনে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য  বরাদ্দ ছিল শূন্য। এর অর্থ, ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা যে উচ্চশিক্ষার অপরিহার্য অংশ, সেটাই অগ্রাহ্য করেছে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রমে বাংলাদেশ যে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে, তারও অন্যতম কারণ যে গবেষণায় দুর্বলতা ও অপ্রতুলতা, তা–ও আমাদের শিক্ষার অভিভাবকেরা বুঝতে চান না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার বরাদ্দের ২ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ১ শতাংশেরও কম ব্যয় করে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমপর্কে তাই আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণাপত্র নেই, যা আছে; তাকে কেবল প্রমোশনপত্রই বলা যায়।’ উন্নত দেশে অধ্যাপক হওয়া যতটা কঠিন বাংলাদেশে অধ্যাপক হওয়া ঠিক  ততটাই সহজ। এজন্যই হয়তো বলা হয়, উন্নত দেশে অধ্যাপক কম কিন্তু গবেষণা বেশি, তাদের তাত্ত্বিক গবেষণায় দেশের উন্নয়ন হয়, আর বাংলাদেশে অধ্যাপক বেশি কিন্তু  গবেষক বা গবেষণা নেই, আর দুই-একজনের থাকলেও তাতে দেশের উন্নয়নে কোন ভূমিকা নেই।

কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের ব্যাপারে কিছু কথা না বল্লেই নয়। বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে থাকেন। সেই আন্দোলনকে ঘিরে জনদূর্ভোগের কথা কারও অজানা নয়। এমনকি চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার মতো মারাত্মক ঘটনাও ঘটেছে  আন্দোলন থেকে। দেশে পঞ্চাশের অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্বেও আবারও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কেন? আমাদের বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.ইউনুসের 'গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন' নামক বইয়ে পড়েছিলাম, জেনারেল আইয়ুব খাঁন শহরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করতেন না।কারণ চুন থেকে পান না খসতেই তারা রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করে জনদূর্ভোগ তৈরি করবেন। সেজন্যই হয়তো তার আমলে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েট সেই ভিত্তিতেই মূল শহর থেকে অনেক দূরে। যায় হোক, আসল কথাতে আসি পড়াশোনার মান নির্ধারণে কোনো প্রতিষ্ঠান কলেজ না বিশ্ববিদ্যালয় সেটি মুখ্য বিষয় নয়। বরং মূখ্য বিষয় হলো শিক্ষার গুণগত মান, গবেষণার সুযোগ, শিক্ষকদের যোগ্যতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোর ওপর।বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, যা ২০২৫ সালে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ৯ম স্থান অধিকার করেছে, মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য পরিচিত। এছাড়াও কিংস কলেজর অবস্থান  ৩৬তম।লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (LSE), যাকে বলা হয় 'ইকোনমিক্সের মক্কা'যা তার অবস্থান  ৫০ তম। বহু নোবেলজয়ী ও প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদই এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। অথচ নামের মধ্যে ‘University’ শব্দ না থাকলেও, এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান MIT (Massachusetts Institute of Technology)-এর নামেও ‘University’ শব্দটি নেই, তবুও এটি গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা। ভারতের সেরা ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টি কলেজ বা ইনস্টিটিউট, যার মাত্র ২টি বিশ্ববিদ্যালয়। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ভারতের শীর্ষ ৬টি প্রতিষ্ঠানই ইনস্টিটিউট। তাদের শিক্ষার্থীরা তো কখনো কলেজ বা ইন্সটিটিউট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে রাস্তা অবরোধ করে, জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে আন্দোলন করেনি? তবে আমাদের এখানে কেন! 

ঢাকার প্রাচীন সাত কলেজ আন্দোলনের মুখে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সাতটি প্রতিষ্ঠানই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। নানা কারণে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন-তখন রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে। আমি চাইনা তারা এভাবে আন্দোলন করুন, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে তা করবেনা, তার নিশ্চয়তা কে দিবে? জনদূর্ভোগের ব্যাপারটি কি সরকার ভেবে দেখেছে!

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সংকট এবং শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ঘোষণা করলেই সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় না, প্রয়োজন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, দীর্ঘ ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনো আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা এবং ন্যূনতম মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে ভুগছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন দীর্ঘ যাত্রা করে ক্লাসে অংশ নেয়। গণপরিবহনে ভিড় ঠেলে সময়মতো ক্লাসে পৌঁছানো, তারপর আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা এই ধকল তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব শুধু ডিগ্রি দেওয়া নয়, শিক্ষার্থীদের গবেষণার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাও জরুরি। কিন্তু যখন তারা ক্লাসে ঢোকার আগেই শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন মনোযোগ ধরে রাখবে কীভাবে?  দীর্ঘ যাতায়াত, অবকাঠামোগত সংকট, মানসম্মত আবাসন ও খাদ্যের অভাব মেধার বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।  
বাংলাদেশের বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। ২০১৮ সালের যুগান্তর পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪ কোটি ৮৫ লাখ বেকার, যার ৫৩ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তারা রাত-দিন পড়াশোনা করেও চাকরির নিশ্চয়তা পান না। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে ঈদেও বাড়ি যেতে পারেন না। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন তাকিয়ে থাকেন সুসংবাদের অপেক্ষায়। গ্রামের মানুষ প্রশ্ন করে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পড়লে, চাকরি কবে হবে?’ এই তীক্ষ্ণ বাস্তবতাই বুঝতে পারে একজন হতাশ স্নাতক। যেখানে গোটা দেশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে, সেখানে শুধুমাত্র ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ তকমা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করা কি শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন নিয়ে ছদ্মবেশী হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়? 

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নানা সংকটের মুখোমুখি, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা, মানসম্মত গবেষণার অভাব, প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং শিক্ষাখাতে বাজেটের সীমাবদ্ধতা। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি এবং দক্ষ শিক্ষকের নিয়োগ নিশ্চিত করাই হবে সত্যিকারের উন্নয়নের পথ। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি গবেষণা ও উদ্ভাবন, যেখানে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে আছে। অতএব, শিক্ষাকে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যম না ভেবে, সেটিকে সত্যিকার অর্থে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করতে হবে। নতুবা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবলমাত্র ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়েই রয়ে যাবে, যা একটি জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।

লেখক: শিক্ষার্থী (এমবিবিএস), দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ। 

আজকালের খবর/ওআর








সর্বশেষ সংবাদ
অফিস সময়ে সভার জন্য সম্মানী না নিতে নির্দেশনা
জাতীয় সংসদে আসন ৬০০ করার সুপারিশ
এনসিপির জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়কের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ৪০
বাফুফের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সরফরাজের পদত্যাগ
সিরাজগঞ্জে চীন বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ছোট্ট পাঠক সাবিহা : পত্রিকা পড়া যার নেশা
ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ নেতা টানু মল্লিক গ্রেপ্তার
কোণঠাসা কোক-পেপসি, জায়গা নিচ্ছে দেশীয় পানীয়
টঙ্গীতে ভাই-বোনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার
বিশ্বে পূর্ব শত্রুদের মিত্রে পরিণত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft