শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫
‘ভয়’ এবং ‘সুখ’ পরস্পর বিপরীতমুখী?
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫, ৭:০০ PM
সুখ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে কম বেশী গবেষণা, আলোচনা, কবির কবিতায়, উপন্যাসিকের উপন্যাসে, প্রবন্ধে, গল্প, নাটকে, সিনেমায় কম  বেশী চিত্র, তথ্য ওঠে আসলেও বাস্তবে সুখের সঠিক ব্যাখ্যা অষ্পষ্ট, অসম্পন্ন থেকে গেছে। তবু কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় এসব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তথ্যে উপাত্তে। কিন্তু সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা রীতিমতো আলোচনার সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী। ঐ গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ‘চাইলে সুখ খুঁজে পাওয়া সম্ভব’। আর এই সুখ ক্যারিয়ার, সফলতা বা অর্থসম্পদের মধ্যে খুঁজে পাবেন না। ব্যায়াম করে আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা বাড়াতে পারি, কিন্তু সুখে থাকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয়। বরং সুখে থাকার জন্য দরকার মানুষ, দরকার পরিবার আর বন্ধু মিলিয়ে চারপাশে সুন্দর একটা ‘সামাজিক সুস্থতা’ তৈরি করা।

১৯৩৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সুখের অন্বেষণ শুরু করেন। তারা ৭২৪ জন মানুষের তথ্য সংগ্রহ করে দুই বছর অন্তর তাদের কাছ থেকে সুখবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর নিতে শুরু করেন। পৃথিবীব্যাপী চলা ৮৫ বছরের এই গবেষণার ফলাফল হলো- মূলত, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্কই পারে মানুষকে সুখী করে তুলতে। এমনকি খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়ামের চেয়ে পরিবার আর বন্ধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আর সুখ সম্পর্কে ফিনল্যান্ডের একটি বহুল প্রচলিত হল ‘হউক ধীরে বা শীঘ্রই, বসন্ত সকলের জীবনেই আসবে।’ এখানে সুখ বলতে বসন্ত বুঝানো হয়েছে। ফিনিশদের বিশ্বাস, জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। এমন বিবেচনা প্রসূত চিন্তা হতে তারা নিজেদের মনের মধ্যে এই বেদবাক্য গেঁথেছে যে, ‘আমার হাতে যা নেই , তা নিয়ে আমি কেন অস্থির হব!’ ফিনিশরা এই গোপন সূত্রও আত্মস্থ করেছে যে, ‘জীবন কখনো দেয়, কখনো কেড়ে নেয়। আজ আমি ভালো অবস্থানে আছি, অন্য কেউ খারাপ অবস্থানে আছে: কাল হয়তো আমি খারাপ থাকব, অন্য কেউ ভালো থাকবে।’

সত্যি এটিই বাস্তবতা। যে সকল জাতি ফিনিশদের মতো করে চিন্তা করতে পারবে, তারা বেশ সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশেই বসবাস করতে পারছে, পারবে। ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নাগরিক ইহার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি একটি সংস্থা বরাবরের মতোই ওয়াল্ড হ্যাপিনেস বা সুখের বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত এ প্রতিবেদনেও ওঠে এসেছে উপরোক্ত সুখী দেশের নাম। টানা অষ্টমবারের মতো তালিকায় এক নম্বরে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড। এটি নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় ব্যাপার বটে। প্রশ্ন হলো, এ সকল দেশের মানুষের হাতে ঠিক কী এমন ‘চাবি’ আছে, যা দিয়ে তারা সুখের অমৃত সুধা পান করছেন আর সুখের সাগরে অবগাহন করে চলছে?

প্রকৃতপক্ষে সুখ অন্যকে দেখানোর বিষয় নয়, এটি অনুধাবন করার বিষয়। এসব দেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সিইওরা পর্যন্ত যাতায়াত করেন সাদামাটা ভলভো বা ভক্সওয়াগনে। অন্যদিকে, যে সকল দেশে সুখের দেখা নেই বলে হা-হুতাশ করা হয়, সেখানকার দৃশ্য কী? সেই সকল দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কি ফিনিশদের মতো সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্থ, বিশ্বাসী? সেই সব  দেশের সাধারণ মানুষও কি সাদামাটা জীবনের সংস্কৃতি ধারণ করতে পেরেছে? বরং যেসব দেশের মানুষ মনেপ্রাণে সাদামাটা জীবনের পরিবর্তে ধারণ করে অন্যকিছু- তাদের ‘চাই চাই আরো চাই’ মনোভাব এবং মূলত এটি তাদের অশান্তি ও বিড়ম্বনার আসল কারণ। এদের চাহিদা, জৌলস বাড়ে পরিনামে সুখ পাখি ধীরে ধীরে তাদের কাছ থেকে অধরা হয়ে যায় এবং অশান্তি, অপ্রাপ্তিতে  বাস্তবে তাদের জীবনে হতাশা বাসা বাঁধে। এসব দেশের মানুষের মধ্যে সংযমের বালাই নেই।

অন্যদিকে সুখী দেশের মানুষ যেখানে মনে করেন, বাধা-বিপত্তি জীবনেরই অংশ; চলার পথে ধাক্কা আসবেই, অপ্রাপ্তি থাকবেই এবং তা সামলাবার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখতে পারলে সুখের দেখা মিলবে; যেখানে অসুখী দেশের মানুষ সারাক্ষণ মনে ‘অজানা ভয়’ পুষে রাখে! অথচ ‘ভয়’ এবং ‘সুখ’ পরস্পর বিপরীতমুখী। এ অবস্থায় সেই সকল অসুখী মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ‘চোখের দিকে’ তাকিয়ে ভয়ের উৎস বা কারণ অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। নুতবা কবির ভাষায় ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল’-এ ধরনের দীর্ঘশ্বাস না ছাড়িয়ে বরং খুঁজে দেখতে হবে, সুখের ‘অসুখ’ বা এ থেকে মুক্তির পথ ঠিক কোথায়?

অবশ্য সুখী মানুষের যুক্তি হচ্ছে-নিজের কাছে কী নেই, সে দিকে নজর না দিয়ে বরং কী আছে-তা নিয়ে ভাবলে, সন্তুষ্ট থাকলে সামনে আগানো সহজ হয়। ‘সুখী মানুষ’ হওয়ার চাবিকাঠি মূলত এটিই। অর্থাৎ, ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখতে হবে। খারাপ সময়ে বিচলিত না হয়ে বরং নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। সুখ কেউ রূপার থালায় সাজিয়ে আপনার সামনে হাজির করবে না; আপনার জীবনের সুখের দায়িত্ব আপনারই। এটি প্রাচীন রোমের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদের মূলকথা। মূলত এই কারণেই সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়া বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, ‘হ্যাপিনেস ইজ আ স্টেট অব মাইন্ড’- তথা সুখ হল মনের ব্যাপার।

কবি বলেছেন, ‘করো না সুখের আশ, পরো না দুঃখের ফাঁস...’। অথচ গানে আছেÑ সুখ তুমি কি আমার জানতে হচ্ছে করে...। সুখ সকল কালে, সকল যুগের মানুষের কাছেই আরাধ্য জিনিস। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দাবি করা হয়, চাইলেই সুখ খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব। আর এই সুখ ক্যারিয়ার, সফলতা বা অর্থসম্পদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং সুখে থাকার জন্য দরকার ‘মানুষ’, দরকার ‘সামাজিক সুস্থতা’। সুতরাং, সুখী হতে চাওয়ার আগে আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের ‘সেই মানুষ’ আছে কি না এবং আমাদের সমাজই-বা কতটা ‘সুস্থ’।

গ্যালাপ, দ্য অক্সফোর্ড ওয়েলবিং রিসার্চ সেন্টার, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) এবং একটি সম্পাদকীয় পরিষদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদন। এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে মূলত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সে দেশের মানুষ বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ায় কিনা, তা বিবেচনা করা হয়।

এটি সত্য যে বিশ্বজুড়ে কমে যাচ্ছে সামাজিক আস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং ‘প্রথাগত ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে ভোটের প্রবণতা বাড়িয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এ এই চিত্র তুলে ধরেছে।  গবেষকদের ভাষ্য, নরডিক দেশগুলোর উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নাগরিকদের জীবনমান উন্নত রাখছে। ‘এই দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক দিক নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থা বেশি।’ কেবলমাত্র সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সুখ নিশ্চিত করে না। বরং সামাজিক বন্ধন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুখের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।

শারীরিক সুস্থতা নিয়ে আজকাল আমরা কমবেশি সবাই সচেতন। সকালে দৌড়ানো, ভালো ঘুম বা স্বাস্থ্যকর খাবার মোটামুটি এসব নিয়ে আমরা সবাই এখন বেশ সচেতন। কিন্তু এসবের পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোও যে আমাদের শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে, সেটি আমরা খেয়াল করি না। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা সব সময়ই শরীর বা মনের যত্ন নিলেও, টাকা পয়সার বিষয়ে সচেতন হলেও আমাদের সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়ার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।

আমরা মনে করি, একবার সম্পর্ক হয়ে গেলেই তো শেষ, সেই সম্পর্ক এমনি এমনিই সামনে এগোতে থাকবে। আলাদা কোনো মনোযোগ না দিলেও চলবে, যাকে বলে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’। অথচ মানবীয় সব সম্পর্ককেও একটা শিশুর মতোই যত্নে লালন-পালন করতে হয়। ছোট্ট একটি চারা গাছের মতোই পানি দেবেন, যত্ন নেবেন, রোদে রাখবেন, বেড়া দেবেন, নিড়ানি দেবেন। তবেই  এই চারা গাছ একদিন মহিরুহ হয়ে আপনাকে ছায়া দিবে, ফল দেবে, ফুল দেবে।

সবচেয়ে বড় কথা, এই ‘সামাজিক সুস্থতা’ আপনাকে দিন শেষে শারীরিক আর মানসিকভাবে সুখী করবে, জীবনে আনবে ভারসাম্য। ভুল ও টক্সিক মানুষকে দূর করে সঠিক মানুষদের নিজের আশপাশে রাখা এবং সম্পর্ক মজবুত রাখা সামাজিক সুস্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।  কিন্তু এটিও সত্য , যুদ্ধ, দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক সংকট, কূসংস্কার, কূপমুন্ডকতা, সন্ত্রাস, সংঘাত, সহিংসতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতায় সুখ শান্তি বিঘ্নিত হয়। স্থানীয়, আঞ্চলিক বৈশ্বিক উদ্যোগে  এসব পরিহার করা গেলে সুখের ব্যাপ্তি, প্রাপ্তি সহজ ও টেকসই হয়। পাশাপাশি ভোগের জন্য আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার তালিকা সীমিত রাখা, উচ্চাভিলাস, অস্থিরতা, অশান্তি, হিংসা, বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা, পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক এবং মানবিক সম্পর্ক মজবুত করা গেলে অর্থ বিত্তে না হলেও মনজাগতিক সুখ পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
জাতীয় সংসদে আসন ৬০০ করার সুপারিশ
এনসিপির জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়কের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ৪০
বাফুফের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সরফরাজের পদত্যাগ
সিরাজগঞ্জে চীন বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন
নির্বাচন দেরিতে হলে দেশের মানুষ হতাশায় ভুগবে: রিজভী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ছোট্ট পাঠক সাবিহা : পত্রিকা পড়া যার নেশা
ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ নেতা টানু মল্লিক গ্রেপ্তার
কোণঠাসা কোক-পেপসি, জায়গা নিচ্ছে দেশীয় পানীয়
টঙ্গীতে ভাই-বোনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মাঝে খাবার পানি বিতরন
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft