শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫
ফাল্গুনের ভরা জোৎস্নায় বিষণ্ন নিঃসঙ্গ জীবনানন্দ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ৪:১৩ PM
আলো আঁধারে মিশে থাকা তীব্র স্রোতের টানে কবিতার দিকে ধাবিত এক কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম রূপকার, এক মহাবিস্ময়ের নাম জীবনানন্দ দাশ। তিনি ব্যক্তি হিসেবে অনাড়ম্বর কিন্তু কবি হিসেবে অসাধারণ। কবির অসাধারণ কবিত্ব প্রতিভা ব্যক্তি কবিকে তেমন কিছুই দেয়নি কিন্তু বাংলা সাহিত্যে দিয়েছে পূর্ণ করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঘুরে ফিরে কিছু শব্দ, কিছু সময়, কিছু উপমা ঘুরে ফিরেই এসেছে বারবার। ঋতু পরিক্রমায় এখন প্রকৃতিতে বসন্তকাল চলছে। চলছে ফাল্গুন মাস। প্রকৃতি চঞ্চল, প্রকৃতির প্রাণীকুলও চঞ্চল। মানুষের মনে আমের মুকুলের মতোই নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। কবি তার কখন উঠেছে চাঁদ কবিতায় লিখেছেন, কখন উঠেছে চাঁদ ফাল্গুনের রাতে/গ্যাসের আলোয় ব্যস্ত বিদীর্ণ মানুষ চাঁদ ভুলে যেতে পারে/শহরের অৎস্র প্রাচীর ব্যস্ত মানুষের মতো/চাঁদ, তুমি কারে চাও?/আমারে কি?/আমার জীবন এই জানালায়/কোন দূর সমুদ্রের পরিত্যক্ত লেগুনের মতো/জীবনের বিস্মৃতিরে ভুলিতেছে বিস্ময়েরে। সেদিনের চাঁদ কাকে চেয়েছিল জানি না, তবে কবি ঠিকই চাঁদকে চেয়েছিলেন আপন করে। সেদিনও বসন্ত ছিল, সেদিনও ফাল্গুনের রাত ছিল এবং সম্ভবত জোৎস্না ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়। বুদ্ধদেববসু তাকে  বলেছেন নির্জনতম কবি। এ ছাড়া রুপসী বাংলার কবি, তিমির হননের কবি উপনামগুলো তার নামের সাথে যোগ হয়ে গেছে। তিনি রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে সবচেয়ে আধুনিক কবিতায় অন্যতম। যার কবিতায় শুধুই মুগ্ধতা। জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে বাংলা কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে, কবিতা খুঁজে পেয়েছে এক নতুন উদ্যামতা। কবিতার ধারায় পরিবর্তন আসে। বহু বছর পর তা হতে পারে শতবর্ষব্যাপী বা তারও অধিকা কাল ধরে একটি ধারা চলে আসে। সেখান থেকে কবিতার গতি বদলে নতুন দিকে বাঁক নেয় কোনো একজন বা একের অধিক কবির হাত ধরেই। জন্ম হয় নতুন ধারা। 

আধুনিক কবিতা যার হাত ধরে বাঁক নিয়েছে তিনি জীবনানন্দ দাশ। কবিতায় এমন একটি পরিবর্তন এনেছেন যেখানে শুধুই নিজস্বতা। যাই হোক আলোচনায় ছিলাম কবির ফাল্গুন ও বসন্ত নিয়ে। কবির জীবনেও তো বসন্ত এসেছে। অনেক বসন্তে হয়তো স্ত্রী লাবণ্যকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তবে জীবনে আনন্দ নিয়ে কবিতা লেখার সুযোগ খুব বেশি হয় নি তার। জীবনে দুঃখই পেয়েছেন বেশি। বসন্ত মানব জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে। তবে সেই আনন্দ কবিকে খুব বেশি ভাবিত করেছে বলে মনে হয় না। কবির মনে ছিল বিষাদ। এই বিষাদ তিনি আবিষ্কার করেছেন ফাল্গুনের কুয়াশায়। তিনি দেখেছেন ফাল্গুনের কুয়াশা মাখা সকাল। শীতের শেষ হলেও ফাল্গুনেও কুয়াশা ঝরে। তিনি তার ফাল্গুনের কুয়াশা কবিতায় লিখলেন, ফাল্গুনের কুয়াশায় দেখা গেল/খড়ের  প্রান্তরে/হিজল-শাখার পিছে বড়ো চাঁদ দীর্ঘ কাল নড়ে/কোথাও ছিল না কেউ/তবু পৃথিবীর সব প্রীত/মাটির ভিতর থেকে যেন/তিনটি প্রবীণ প্রাণ হল উজ্জীবিত/তারা খড় গুছাতেছে- বহু ক্ষণ/শরীরের মাংস থেকে খ’সে গিয়ে ছায়ায় হারিয়ে/ এইখানে- পৃথিবীর- আদি খেতে যেন প্রেম- পেঁচা/চাঁদে পৌঁছাতে পারে মাখনের পাখনা বাড়িয়ে/সোনালি খড়ের আঁটি বেঁধে যায়/দাঁড়ায়ে দেখে যাই সব/বহু ক্ষণ হরিতকী-কান্ডের আড়ালে/ইঁদারার মতন নীরব/আজ নয়। এক দিন শুধাতাম যদি আমি ইহাদের/নাই কি সত্ত্বের চুক্তি রাষ্ট্রের কাছে/বলিল সম্পূর্ণ চাঁদ: “তরুরও সমাপ্ত হল কাজ/তোমার মতন কেউ অসমাপ্ত আছে?” কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের পান্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে রচিত। যা ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। কবি প্রগাঢ়ভাবে প্রকৃতির সাথে মিশেছেন, উপমা তৈরি করেছেন এবং সেসব কবিতায় ছড়িয়েছেন স্বর্ণখণ্ডের মতো করে। এজন্যই কবির কবিতাগুলো পড়তে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য হয় এবং দীর্ঘ সময় পাঠক তা ধরে রাখে। কবির মৃত্যু রহস্যে ঘেরা। কবির দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে জোর বিতর্ক রয়েছে। কবির বেকারত্ব এবং হতাশার সময়কালে বেশকিছু গল্প ও উপন্যাস লিখেছিলেন। 

তবে এখানেও দুর্ভাগ্য যে সেসব তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। এমনকি জীবদ্দশায় তিনি আজ যেভাবে সমাদৃত হচ্ছেন সেভাবে সমাদৃতও হননি। বিপরীতে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। তীরবিদ্ধ হয়েছেন বহু জনের কাছ থেকে। তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলের শিক্ষকতা করে সেই অভাব পূরণের চেষ্টা করেছেন। কবি তার জীবনবোধ নিয়ে কতটা দুঃখিত ছিলেন সেটি কবির কবিতা পড়লেই খুব সহজে অনুমান করা যায়। যারা কবিকে দেখেছেন বা সঙ্গ দিয়েছেন তাঁরাও সেটি স্বীকার করেন। কবির ফাল্গুন নিয়ে কবি লিখেছেন,  মানুষ যখন ফাল্গুনের হাওয়ার রাত্রে ঘুমিয়ে থাকে/জানালার কাছে সবুজ মাঠে/গভীর রাতে এই সব বড়-বড় শাদা মেঘ দেখা দেয়/আমার হৃদয়ে কিছুতেই আর ঘুম আসে না/ ঘুম কিছুতেই আসে না আর। কবিতার এই কয়েকটি লাইনই যথেষ্ট এটা বোঝানোর জন্য যে কবি ফাল্গুনের রাতে কতটা বিমর্ষ ছিলেন। কতটা মুগ্ধ বিষণ্ন নয়নে তিনি রাত্রিযাপন করতেন। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যে যার কবিতা সবথেকে বেশি সমাদৃত, অনুসৃত তিনি জীবনানন্দ দাশ।  তার কবিতায় উঠে এসেছে প্রেম, নারী, রোমান্টিকতা, ভালোবাসা, দেশাত্ববোধ। বলা হয় রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে ম্ক্তু করেছে তার কবিতা। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ঘটিয়েছেন। তার কবিতার ধারায় আজ আধুনিক কবিদের কবিতা রচিত হচ্ছে। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে ব্যর্থ। তার সৃষ্টির সমাদর তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। বিষন্ন, স্বপ্নময়, আশ্চর্য শোভাময় কবিতার মধ্যে ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ সোনার টুকরোর মতন কবিতায় ফুটে উঠেছে। ফাল্গুনের রাত আমাদের রোমান্টিক করলেও কবিকে করেছে ব্যথিত। 

কবির আট বছর আগের একদিন কবিতায় লিখেছেন, শোনা গেল লাসকাটা ঘরে/নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হ’লো তার সাধ/বধূ শুয়ে ছিলো পাশে শিশুটিও ছিলো/প্রেম ছিলো, আশা ছিলো জ্যোৎস্নায়/তবু সে দেখিল/ কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?/অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!/রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার/কোনোদিন জাগিবে না আর। ফাল্গুন কবির বহু কবিতায় বহুবার ঘুরে ফিরে বহুরুপে ধরা দিয়েছে। কখনো নারী, কখনো আকাশ আবার কখনো কবির হৃদয় হয়ে ফুটেছে কলমে। কবির নগ্ন নির্জন হাত কবিতায়- যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি/ সেই নারীর মতো/ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠছে/যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি/সেই নারীর মতো/ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হ’য়ে উঠছে। আবার কবির হরিণেরা কবিতায় লিখেছেন, স্বপ্নের ভিতরে বুঝি- ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে/দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে/হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়/বাতাস ঝরিছে ডানা- মুক্তা ঝরে যায়। অন্ধকার যেভাবে নিবিড় হয়ে উঠেছে কবির কবিতায়, কবি ততই নিবিড় হয়েছে উঠেছেন বাংলা কবিতায়। বসন্তের ফাল্গুন কি না ঠিক বোঝা যায় না কবির কবিতার ফাল্গুনের বর্ণনার সাথে। তবে ফাল্গুন নিয়ে একগুচ্ছ কবিতায় কবি স্বভাবচরিতভাবে তুলে এনেছেন প্রকৃতির সাথে গভীর জীবনবোধ আর হতাশার ছবি। ফাল্গুন দিয়েই লেখা শেষ করছি। কবির ফাল্গুনের বিকেল বেলায় কবিতায় লিখেছেন, যখন দৈবের কাছে বল চেয়ে ফাল্গুনের বিকেল বেলায়/একাকী পথের রেখা ধ’রে নিয়ে প্রাণ/মিনারে উন্নীত এক সাদা নগরীর/মৃত রমণীর মতো ধূসর সোপান/ অনেক দূরের থেকে দেখেছিল/প্রতীতি নিজের মনে কাজ করে চলেছে শিথিল/অনেক দূরের থেকে অল্প-শীত সারা বীথিকায়/শুনেছিল বিকেলের মাছিদের গান/বাতাস কী মনে ক’রে একটু ফেনিল/চ’লে গেলে পরে নীল আকাশের কাছে আশাশীল। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
জাতীয় সংসদে আসন ৬০০ করার সুপারিশ
এনসিপির জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়কের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ৪০
বাফুফের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সরফরাজের পদত্যাগ
সিরাজগঞ্জে চীন বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন
নির্বাচন দেরিতে হলে দেশের মানুষ হতাশায় ভুগবে: রিজভী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ছোট্ট পাঠক সাবিহা : পত্রিকা পড়া যার নেশা
ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগ নেতা টানু মল্লিক গ্রেপ্তার
কোণঠাসা কোক-পেপসি, জায়গা নিচ্ছে দেশীয় পানীয়
টঙ্গীতে ভাই-বোনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মাঝে খাবার পানি বিতরন
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft