রবিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৫
চাক বাংলা অভিধান ও চাক সংস্কৃতি চর্চা
রকি গৌড়ি
প্রকাশ: শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ৪:০৭ PM
বন-পাহাড়ের চাক পাড়াতে কারা যেন গান গাইছে  ‘ঙাগা শৈছাং বাংলা (আমার সোনার বাংলা) /ঙা নাংঙাং রামাকহে (আমি তোমায় ভালোবাসি)। ভাষার মাসে শুনি চিরচেনা সুরে ‘ঙাগা হুব্রারাক্কা ছেইং লুহেকা একুশে ফেব্রুয়ারি’ (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি), ঙা ছাকতা মাইক ক্লাংলুগালে (আমি কি ভুলিতে পারি)’। বলছি এক জনগোষ্ঠীর ভাষার কথা। তারা হলেন নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ চাক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্য সমৃদ্ধিতে তাদেরও ভূমিকা রয়েছে। চাকরা বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় বাস করে। এ ছাড়া মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসতি রয়েছে। চাকদের বলা হয় সা ক বা মিঙসাক। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইশারি, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, বাকখালী, দোছড়ি, বাদুরঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গায় চাক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ১৪টি পাড়ায় চাকদের বাস। রাঙ্গামাটি বা খাগড়াছড়ি জেলায় চাকদের কয়েকটি পরিবার বিক্ষিপ্তভাবে শহরের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বসবাস করে। 

মেধাবী তরুণ ছাগ্যহ্লা চাক। পড়াশোনা জীবনে স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। চাক ভাষায় অনুবাদ করেছেন জাতীয় সংগীত এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি। বতর্মানে চাক ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর  ‘পাইক চুং’ ব্যান্ডের প্রধান ভোকালিস্ট হয়ে গান রচনা, সুর ও কণ্ঠ দিচ্ছে এই তরুণ।  সম্প্রতি তার পরিচালনায় ইউটিউব চ্যানেল ‘চাক ফিল্মস’ প্রকাশ পেয়েছে চাক ভাষায় গান ও নাটক।  চাক সমাজে অন্যান্য তরুণ শিল্পী, মডেল, গায়কদের মধ্যে রয়েছে- জীবন চাক, উখ্যাইচিং চাক, য়াইনুপ্রুফ চাক, ও মিয়া সাইন চাক, চিংমংলা চাক, চাইল্যাগ্য চাক। বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকদের কোনো লিখিত বর্ণমালা ছিল না। সুদীর্ঘ বিশ বছর গবেষণা করে ২০১১ সালে চাকদের এই বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন মংমং চাক। তিনিই প্রথম চাকদের বর্ণমালা উদ্ভাবন করেন।

চাক ভাষার সমাজচিন্তক ও গবেষক, চিংলামং চাকের মতে  কাডু, কানাং জাতির সাথে চাক ভাষার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মিল রয়েছে যেমনÑ উতি, উছা, ই ক্রু হে, লাংগা স্থলে লাংমে, তানা কে তাঙা ইত্যাদি হুবহু মিল রয়েছে।

চিংলামং চাক জানান বর্তমানে এই নিয়ে বারমা ও সাক জাতির মধ্যে আলোচনা ও গবেষণা চলছে। এবারের বই মেলায় বিশ্ব ভাষার গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রকাশ করেছে চাক বাংলা অভিধান। এই অভিধানে প্রায় ১২০০ শব্দ রয়েছে। এই শব্দের ভেতরে যেমন একক চাক শব্দ রয়েছে তেমনি আছে মারমা, রাখাইন ও বার্মিজ ভাষার শব্দ। চাকভাষীদের নিজস্ব মৌলিক চাকের সঙ্গে এই সকল শব্দগুলো নানা প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে। তবে এই সংকলন অভিধানে শব্দগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে এর উৎস অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। চাক ভাষীদেরও সঙ্গে কথপোকথনের ভিত্তিতে এবং চাকভাষা সম্পর্কে কিছু বইপত্র থেকে শব্দগুলো এখানে সঙ্কলিত হয়েছে। যেমনÑ চাক ভাষার সংখ্যাবাচক শব্দ এবং প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ‘আনোঃতু সনিংগাঃ, অংখ্যাই চাক’ বই থেকে। কিছু শব্দ পাওয়া গেছে ‘বাংলাদেশের নানান ভাষা; মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা নম্বর ২৯; প্রথমা প্রকাশন; প্রথম প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪’ থেকে। চাক গোষ্ঠীর মেধাবী শিল্পী ছাগ্যহ্লা চাক দুটি গান ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং একুশের গান’ চাক ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সেখান থেকেও কিছু চাক শব্দ পাওয়া যায়।

চাকভাষীদের উচ্চারণের আদলেই এই শব্দগুলোর উচ্চারণরীতি দেখানো হয়েছে। এই উচ্চারণ রীতিতে আই. পি. এ. অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ধ্বনি ও বর্ণমালা ব্যবহার না করে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি শব্দের অর্থ জ্ঞাপন করার পাশাপাশি প্রয়োগ বাক্যের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। শব্দগুলো বাংলা অভিধানের বর্ণানুক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছে। শব্দের বানান ও উদাহরণ বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে।  চাক বাংলা অভিধান প্রকাশে আনন্দ প্রকাশ করেন, চাক সমাজের জনপ্রিয় কনন্টেট ক্রিয়েটর জীবন চাক। তিনি বলেন, ‘চাক বাংলা অভিধানের বিষয়বস্তু আমার ভালো লেগেছে, বইটি আমার এবং চাকসমাজের জন্য অনেক কাজে আসবে।’ চাকদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, লোককথা, গান, ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ। উৎসবের মধ্যে আছে, থিংকানাই (গ্রাম রক্ষক দেবতার কাছে বলী উৎসর্গের উৎসব), লাব্রে (অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা), সাংগ্রাই, কাথিং পোয়ে (কঠিন চীবর দান) উৎসব, কাতাং য়িশু পোঃ, তেংছংবুক লাব্রে (কার্তিক পূর্ণিমা), আংনাইবুক পোয়ে (নবান্ন উৎসব) ইত্যাদি  সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। শিশুর জন্ম ও নামকরণ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদির মধ্যে নাইংছাঙাহাং-এ অবস্থান, পুতরংবুওয়ে (জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠান), ভেগলুংশাত পো (চুংবংলং উচ্ছেং ছাহেকা) উলে¬খযোগ্য। বিবাহ সংক্রান্ত প্রথার মধ্যে আচাংগায়ুগা (কনে দেখা), চাঁগায়ুগা (কোষ্ঠী বিচার)-সহ আরো অনেক প্রথা পালন করা হয়। এ ছাড়া মৃত্যুপরবর্তী আচার, কাবাকে শয়ন, তালাহ্-তে স্থাপন, দাহকার্য, কাঙবোয়েং (শুদ্ধকরণ), ছানিংওয়াক্ সভীক ফ্রেহ, সাইন্ বলব্ (পুনঃজন্ম কামনা) চাকদের নিজস্ব সংস্কৃতিগুলির মধ্যে উলে¬খযোগ্য। চাক সমাজের কবি, লেখক ও গীতিকারদের মধ্যে রয়েছে ওয়াং চিংচাক, চামাপ্রু চাক, নাংউচাক, চাইছাঅং চাক,মংনু চাক, এম আর চাক, মং কোচিং চাক, মংমং  চাক  (চাক বর্ণমালার উদ্ভাবক), অংখ্যাই চাক, এছাইনচিং চাক, চিংলামং চাক, ছক্রাঅং চাক, চিং ছালা চাক, এমেশ চি সত্যেন চাক, জীবন চাক, ছাগ্যহ্লা চাক, উখাইচিং চাক।  নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও চাক সমাজের তরুণেরা থেমে নেই। আশা করছি থেমে থাকবে না। পরিশেষে বলা যায় চাক জনগোষ্ঠীর  ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।


আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক এমপি গ্রেপ্তার
ইরানে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ২৫, আহত ৮ শতাধিক
মাঠকর্মী দেখে দরজা বন্ধ করে ফাঁস নিলেন ঋণগ্রস্ত যুবক
ত্রয়োদশ বিসিএস ফোরামের সভাপতি মাহবুব, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর
নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা চায় জামায়াত: তাহের
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কটিয়াদীতে বেকার যুবকের হাতে অটোরিকশা তুলে দিলেন শিল্পপতি মাহমুদুল ইসলাম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর চরম উত্থান ঘটেছে: ইবি শিক্ষক
ইসরায়েলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল ইয়েমেন
পাকুন্দিয়ায় ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে দুই বৃদ্ধ গ্রেপ্তার
জাতীয় গ্রিডে ত্রুটি, দক্ষিণের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft