দীর্ঘ ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বিধ্বংসী যুদ্ধের অবসানে অবশেষে রোববার সকাল থেকে গাজায় কার্যকর হতে যাচ্ছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বন্দিদের মুক্তির চুক্তি অনুমোদন পাওয়ায় স্বস্তির আশায় প্রহর গুণছেন ফিলিস্তিনিরা।
মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বুধবার গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। চুক্তিতে পৌঁছানোর ঘোষণা দেওয়ার পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছে। শনিবার গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা উদ্ধার সংস্থা বলেছে, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় একটি পরিবারের অন্তত পাঁচ সদস্য মারা গেছেন।
একই দিন সকালে সাইরেন বাজিয়ে বাসিন্দাদের সতর্ক করে দেওয়ার পর জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, জেরুজালেম লক্ষ্য করে ইয়েমেন থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা এই হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া বার্তায় বলেছেন, ‘‘চুক্তির উভয়পক্ষ ও মধ্যস্থতাকারীদের সমন্বয়ে গাজার স্থানীয় সময় ১৯ জানুয়ারি (রোববার) সকাল সাড়ে ৮ টায় যুদ্ধবিরতি শুরু হবে উপত্যকায়।’’
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরায়েলের ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে কেবল ২০২৩ সালের নভেম্বরে এক সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল।সেই সময় চুক্তি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
শনিবার সকালে মন্ত্রিসভায় ভোটাভুটির পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, ‘‘সরকার জিম্মি ফেরত পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।’’ চুক্তিটি যুদ্ধের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করেছে বলেও নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে।
অবশ্য শনিবার এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ইসরায়েল তার আগ্রাসী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এবং কেবল এমন যুদ্ধাপরাধে সফল হয়েছে; যা মানবতার মর্যাদাকে কলঙ্কিত করে। ইসরায়েলের বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে, চুক্তির প্রথম ধাপের অংশ হিসাবে রোববার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টার দিকে ৭৩৭ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জসিম আল-থানি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতিতে গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি ৩৩ জন মুক্তি পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের আগের দিন এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রশাসনের আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের পর ‘‘গাজায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের’’ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা শাসনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনও অবস্থান তুলে ধরেনি ইসরায়েল। যদিও বিদায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, গাজাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার আগেই বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীরা নিজ বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গাজার দক্ষিণের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শহরটির বাসিন্দা নাসর আল-গারাবলি বলেন, ‘‘আমি আমার ভূমি চুম্বন করতে যাব। আমার ভূমিতে মারা গেলে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি হিসাবে এখানে থাকার চেয়ে সেটিই ভালো হবে।’’
শনিবার জেরুজালেমের বাসিন্দারা বলেছেন, চুক্তিতে অনেক দিন সময় লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বীরি ইয়েমেনি বলেছেন, ‘‘সর্বাধিক সংখ্যক জিম্মি ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা করছি। এটি উভয়পক্ষের দুর্ভোগের সমাপ্তির সূচনা। এই যুদ্ধ অনেক আগেই শেষ হওয়ার দরকার ছিল।’’
ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা এই চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। যদিও আটজন মন্ত্রী চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন; যাদের মাঝে রয়েছেন ইসরায়েলের উগ্র-ডানপন্থি মন্ত্রী ইতামার বেন গভির এবং বেজালেল স্মোরিচ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজার বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েলি এই বর্বর যুদ্ধে ৪৬ হাজার ৮৯৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; যাদের অধিকাংশই বেসামরিক। মধ্যস্থতাকারীরা চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য কয়েক মাস ধরে কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের অভিষেকের কাছাকাছি সময়ের আগে পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থই ছিল।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিয়োগ করা ব্রেট ম্যাকগার্কের সঙ্গে ওই অঞ্চলে কয়েক দিন ধরে বেশ ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ৩৩ বন্দি জীবিত বলে ধরে নিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। তবে হামাস এখন পর্যন্ত তা নিশ্চিত করেনি। কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রথম ধাপে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে প্রত্যাহার করা হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ‘‘তাদের বাসস্থানে’’ ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবে।
ইসরায়েলি সামরিক এক কর্মকর্তা বলেছেন, কেরাম শালোম, এরেজ এবং রেইমে জিম্মিদের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে জিম্মিদের ইসরায়েলের হাসপাতালে ‘‘উড়োজাহাজ অথবা গাড়িতে করে পরিবহন’’ করা হবে। তার আগে চিকিৎসক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জিম্মিদের শারীরিক অবস্থা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র বলেছে, ইসরায়েল তখন ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রথম দলকে মুক্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে; যার মধ্যে কয়েকজন উচ্চ সাজাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিও থাকবেন।
শুক্রবার আলোচনা চলাকালীন মধ্যস্থতাকারীরা ফলপ্রসূ সমন্বয় নিশ্চিত ও যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলার জন্য কায়রোতে একটি যৌথ অপারেশন রুম স্থাপনে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলে মিসরের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে। বাইডেন বলেছেন, চুক্তির দ্বিতীয় পর্বে যুদ্ধের স্থায়ী অবসান ঘটবে।
আজকালের খবর/ এমকে