কবিতা বাংলা সাহিত্যের আদি শাখা হলেও, বাংলাদেশে মৃত্যুর আগে কোনো কবিই সেভাবে বড়ো এবং বিখ্যাত কবি হয়ে উঠতে পারেন না, যদি বাংলা একাডেমিতে পদ-পদবি এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার না থাকে! আর যদি কেউ জীবদ্দশায় বিখ্যাত কবি হয়েও যান, তাকে নিচে নামাতে যত চেষ্টা ও আলোচনা-সমালোচনা, আমরা তার সর্বোচ্চটি করতে, একটুও কণ্ঠিত বোধ করি না।
কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই/দুঃখ তো সুখের মতো নিচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।’ কবিতার নাম, ‘বেদনা কে বলছি তুমি কেঁদো না’। দুঃখ নিয়ে এমন সহজ কথাও যে কবিতা হতে পারে, এটি হেলাল হাফিজই দেখিয়েছেন। কবি হেলাল হাফিজের কবিতা যখন মাধ্যমিকে পড়তাম, তখনই প্রথম শুনেছি, যদিও তখন জানতাম না কবিতাটি ছিল হেলাল হাফিজের কবিতা! সেই কবিতাটি ছিলোÑ ‘কষ্ট নেবে কষ্ট, হরেক রকম কষ্ট আছে, কষ্ট নেবে কষ্ট! লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙে কষ্ট...’
এ কবিতাটিই মনে হয় হেলাল হাফিজের যত কবিতা তার মধ্যে অন্যতম, বিশেষ করে যতগুলো কবিতা আবৃত্তি হয়ে থাকে এবং পাঠকপ্রিয়। কেউ কেউ বলে থাকে, হেলাল হাফিজ নিঃসঙ্গতার কবি। যদিও একজন কবিকে নিঃসঙ্গতার মোড়কে বন্দি করার মধ্যে কী বিশেষত্ব আছে, এবং তা কতটুকু যৌক্তিক আমি সেদিকে যাবো না। কারণ, কেউ কেউ আবার প্রেম ও দ্রোহের কবি বলেও অভিহিত করে। এসব বিষয় অনুধাবন করেই আমি বলতে চাই, কবিকে নির্দিষ্ট খোলসে আবদ্ধ করা পাঠক এবং চিন্তকের সীমাবদ্ধতা বৈকি ভিন্ন কিছু নয়। আমি যে কবিতাংশ দিয়ে শুরু করেছি, সেদিকেই একটু দৃষ্টিপাত করাতে চাই, কবিতার নাম; ‘বেদনাকে বলছি কেঁদো না’ অথচ পুরো কবিতার কোথায় ‘এ শব্দমালা’র উপস্থিতি নেই। এমন বিরল ঘটনা তথা নামকরণই বাংলা সাহিত্যের উপমা। যার, একটি শব্দ কিংবা একটি বাক্য বিশ্লেষণ করতে গেলে কয়েকটি উপন্যাসের সমান হয়ে যেতে পারে। কবি বলেছেন, ‘আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই/দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।’ এখানে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। প্রথমত, দুঃখ কাউকে দুঃখী করতে পারে না, দুঃখ জীবনের অন্যান্য উপকরণের মতোই সাধারণ একটা অনুসঙ্গ বা উপাদান। আর সেটিকেই কবি তার কবিতার উপমা বানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, সুখ যেমন সবাইকে ছুঁয়ে যেতে পারে, দুঃখ সেভাবে পারে না। দুঃখকে কাছে টেনে নিতে হয়, এক জীবনে উপভোগ করতে হয়, নিজের মতো করে। আর, সে দুঃখকেই কবি তার পুরো কবিজীবনে উপমা হিসেবে নিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে তার বিভিন্ন কবিতা থেকে, সেটিই প্রমাণ করার চেষ্টা করে এগিয়ে যাব; ‘দুঃখ বোধই হেলাল হাফিজের কবিতার উপমা’র দিকে। কেন এবং কীভাবেই এ দুঃখ বোধ কবির ব্যক্তি জীবনের উর্ধ্বে উঠে উপমা হয়েছে কবিতার পটে পটে।
‘‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা/কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস/ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন...‘পেয়েছি, পেয়েছি’।’’ নিশ্চয় এ কবিতাটি পড়েছেন, যদি না আপনি হেলাল হাফিজের কবিতার পাঠক হয়ে থাকেন। দুটো প্রশ্ন রেখেই এ কবিতার সাথে পতকার কী সম্পর্ক তা খোঁজার চেষ্টা করি। কবি হেলাল হাফিজের ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতাটির পটভূমি এবং সময়কাল আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি, আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে পতাকা পায়, স্বাধীনতা পায়; আমাদের বিজয়ের কবিতা লিখার কথা ছিলো, কথা ছিলো, একটি পতাকা পেলে, আমি লিখবো স্বাধীন মানচিত্রের কবিতা, বিজয়ের কবিতা, লাল-সবুজের কবিতা! অথচ, তিনি লিখেছেন, ‘আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা!’ কারণ, এটি কখনোই কবির ব্যক্তিগত কষ্ট ছিলো না, জাতীর ক্রান্তিকাল ছিলো, ফলে সে সময় উত্তরণের পরও সেই দুঃসময়কেই উপমা করেছেন! তিনি জানতেন, দুঃখের মতো পরশ পাথর ভিন্ন আর একটিও হতে পারে না। এখানেই, কবিত্ব। এখানেই হেলাল হাফিজের ব্যক্তিগত জীবনের উর্ধ্বে উঠেছে কবিতার শৈল্পিক শব্দচয়ন। যার ফলে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক লাইনের একটা সাধারণ কথা, ‘নিউটন বোমা বুঝ, মানুষ বুঝ না’ লিখেই কবি ও কবিতার অমরত্ব পেয়েছেন।
এবার ফিরে দেখা যাক হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘যে জ্বলে আগুন জলে’, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। যার প্রথম কাবিতা, ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়!’ এখানেই কবি লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/মিছিলের সব হাত/কণ্ঠ/পা এক নয়।’ আপাতদৃষ্টিতে এটি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কবিতা হলেও, বাঙালি জাতীয় জীবনের সামগ্রিক আন্দোলনের পথে মানুষকে উৎসাহী করে কবিতা। কিন্তু, ভিন্নভাবে দেখলে; এখানেও কবি তার মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলেছেন, পাঠকের সঙ্গে। কবিতাটি যে ভাবধারায় লিখা হয়েছে, পুরো কবিতায় সে ভাবধারার পরিবর্তে আবারো ফিরে গেছেন, দুঃখবোধের কাছে। অথচ তিনি লিখতে পারতেন, বুলেট-বোমা, ট্যাংক কিংবা সাঁজোয়াযানের কথা, কিন্তু তিনি লিখলেন; ‘সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে/কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।’ অর্থাৎ যে কবিতায় যুদ্ধের আহ্বানে শুরু সে কবিতায় চলে এসেছি ‘সাংসার বিরাগী’ এমনকি প্রেমিক খুনি; যাদের অবয়ব থরে থরে দুঃখবোধ দিয়েই সাজানো। এসব দুঃখবোধ কবির ব্যক্তিগত জীবন নয় বরং কবিতার উপমা। আর এখানেই কবিত্ব, যখন একজন কবির কবিতা পড়লে, তা পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দিবে। তবে, কেউ যদি কবিতার দুঃখ-কষ্টকে কবির ব্যক্তিগত জীবন হিসেবেও ধরে নেয়, তাতেও এসব যে উপমা তা অস্বীকার করা হবে নির্বোধের নামান্তর।
কবি হেলাল হাফিজের আরেকটি অন্যতম কবিতা, ‘প্রস্থান’, যেখানে কবি লিখেছেন, ‘এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো/এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা/খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো/ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত/ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।’ কবিতাটি যদি আপনি শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত পড়েন, বলবেন এটি নিরেট একটা প্রেমের কবিতা! অথচ, এখানেও বিরহ আছে, ব্যথা আছে! এসব ব্যথা কবির জীবনের নয় বরং উপমার! আমি একটি বিশেষ লাইনকে আবার ইঙ্গিত করছি, ‘ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত!’ এখানেই দেখুন, ক্যালেন্ডারের পাতাটি ছেঁড়া হতে পারত, অথচ তিনি ছেঁড়া উপমা না দিয়ে, ‘ব্যথিত’ উপমা দিয়েছেন। কারণ, ছেঁড়ার চেয়ে ব্যথিত উপমায় যথেষ্ট কাব্যিক এবং শক্তিশালী। ঠিকই একই ভাবে কবি তার প্রায় সকল কবিতাকেই দুঃখবোধের উপমা দিয়েই সাজিয়েছেন এবং অলংকার হিসেবে দুঃখবোধকেই বেঁচে নিয়েছেন। এবার ‘নেত্রকোনা’ কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে, ‘কতো দিন তোমাকে দেখি না/তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোনা/আমাকে কি চিনতে পেরেছো? আমি ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক নিকট-আত্মীয়/আমাদের বড়ো বেশি মাখামাখি ছিলো,/তারপর কী থেকে কী হলো/আভাইগা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো/দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোন দিন জিজ্ঞেস করো না/আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না/কী এমন অভিমানে আমাদের এতো ব্যবধান,/কতোটা বিশৃংখলা নিয়ে আমি ছিমছাম সন্নাসী হলাম।’ জন্মস্থানের প্রতি গভীর মায়া-মমতাবোধ থেকে রচিত এ কবিতায় কবির সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ পেলেও তিনি ব্যক্তিগত দুঃখবাদকে পূজি করেই, এখানেই তৈরি করেছেন কবিতার অবয়ব। নাড়িরটানকে উপেক্ষিত করে চাষাবাদ করেছে দুঃখবাদের, তাই তিনি যেমন অভাগা, বিচ্ছেদের বিষ, অভিমান এবং সন্ন্যাসীর মতো শব্দগুলোকে প্রোথিত করে তখন এসব ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে কবিতার উপকরণ হয়ে উঠে দ্বিগুণভাবে।
‘হিরণবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন/যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে/ফুলের কাছে মৌমাছিরা/বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী/খোদার কসম হিরণবালা/তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমনি ঋণী।’ কবিতাটি পাঠান্তে একটা প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিকÑ হিরণবালা কে? যদিও আমাদের সবার জানা, কবির প্রেমিকার নাম হেলেন, তাহলে কি তিনি হিরণবালা নামে ভিন্ন কাউকে ভালোবেসেছেন? অথবা হেলেনের আরেক নাম কি হিরণবালা অথবা নিকট আত্মীয়দের কেউ কি হিরণবালা? এমন সব প্রশ্নের উত্তর যদি আপনাকে খুঁজতে হয়, এ একটি কবিতা নয়; কবি হেলাল হাফিজের সামগ্রিক কবি জীবন এবং কবিতাকেই বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ, তিনি মা-বাবার পরে তার কাছেই ঋণী হয়েছেন। যে প্রেমিকাকে তিনি ভালোবেসে নিজের করে পাননি, তার কাছে কেন তিনি এত ঋণী হতে যাবেন? বরং তিনি হেলেনের বিরহে ব্যথিত হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন, আর এসব দুঃখই তাকে কবি খ্যাতি এনে দিয়েছে। এসব দুঃখই তার কবিতার পরতে পরতে লেগে আছেন অন্যান্য স্বাভাবিক শব্দ-বিষয়ের মতো! ফলে, এখানে স্পষ্টত বলা যায়, হিরণবালা মূলত দুঃখবোধের সেই বালিকা, যা দিয়ে কবিতা সাজিয়েছেন, সাজিয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত জীবন। কেবল হেলাল হাফিজ কেন? আমি নিজেও মনে করি, এমন দুঃখবোধ থাকলেই তার কাছে ঋণী হওয়ার ব্যতিক্রম কিছু নেই, দেখি না।
এবার ফেরা যাক, প্রারম্ভিক বিষয়ের দিকে! তবে, বাংলা কবিতার সঙ্গে হেলাল হাফিজের সম্পর্কটা একান্তই এক-রোখা এবং পক্ষপাতিত্বসুলভ। কারণ, তিনি যতটুকু দিয়েছেন এটি কেবল তার নিজের ব্যক্তিগত জীবন এবং দুঃখবোধ। সামগ্রিক সাহিত্যবোধের তেমন কিছুই আমরা তার কবিতায় পায় না, কেবল কয়েকটি কবিতা ছাড়া! অথচ, তিনি চাইলে আরো দিতে পারতেন। যদিও এটি আমাদের অনেকেরই মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা তবে, এর উপর কারো সৃষ্টি বা লেখনি নির্ভর করে না। একইভাবে এটিও অনুধাবন করতে হয়, এখানে যে যতটুকুই দিবে, তা কোনো না কোনো দোষে দুষ্ঠ এবং কালিমায় লিপ্ত। ফলে, সামগ্রিক বিয়য়ে হেলাল হাফিজের কবিতা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা এবং যুক্তিতর্ক হতে পারে, আমি সেদিকে আর যেতে চাই না। কারণ, কবিতা তাই, যা একেক পাঠকের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। এ জায়গায় কবিরা যথাযথ; হেলাল হাফিজও যথাযথ।
আমি যে কয়েকটি কবিতা থেকে, প্রমাণ করতে চেয়েছি, ‘দুঃখবোধই হেলাল হাফিজের কবিতার উপমা’ এটিই শেষ নয়; তার কবিতায় আরো অনেক কিছুই আছে, যা জানতে হলে; তাকে নিরন্তর পড়তে হবে; খোঁজতে হবে কবিতার পরতে পরতে, তবেই আমাদের বাংলা সাহিত্যের কবিতায়, কবি ও কবিতার যে দৈন্যতা নেমে এসেছে, তা কিছুটা হলেএ লাগব হবে।
আজকালের খবর/আরইউ