হারুকি মুরাকামি একজন জাপানি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক। দেশ-কালের সীমানার পেরিয়ে মুরাকমির লেখা মন কেড়েছে সারা বিশ্বের মানুষের।
মুরাকামির জনপ্রিয়তার কারণ তার লেখার সহজ সরল ভাষা ও গল্প বলার সুকৌশলী ঢং। বিশ্বের প্রায় ৫০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তার লেখা। ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি জাপানের কিয়োটাতে জন্মগ্রহণ করেন মুরাকামি। কোবেতে বড় হন এবং পরে টোকিওতে চলে যান, যেখানে ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রামা নিয়ে পড়াশোনা করেন মুরাকামি। ষাটের দশকের শেষদিকে টোকিওতে ছাত্রজীবন কাটানোর ফলে তার মধ্যে আধুনিক সাহিত্যের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি। একই সঙ্গে একটি ক্যাফের ব্যবসাও শুরু করেন স্বামী-স্ত্রী মিলে। ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল ক্যাফেতে বসে কাজের ফাঁকে তার মাথায় আসে তার প্রথম আইডিয়া। সে সময় লেখা শুরু। কফিশপের ব্যবসা সেরে বাড়ি ফিরে তিনি রোজ এক ঘণ্টা করে লিখতে থাকেন এবং ছ-মাস ধরে টানা লিখে এই উপন্যাসটি শেষ করেন যেটির নাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’। এই বই তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দেয়। জাপানের এমন একজনকে পাওয়া যাবে না, যে কিনা বইটি পড়েননি বা এর নাম শোনেননি। হারুকি মুরাকামির লেখা সবসময়ই জীবনমুখী।
তার বেশিরভাগ উপন্যাসের চরিত্রগুলো সবসময় বিষাদময়। তার গল্প যেন খুব সাধারণ। তবে তার অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গি সেই গল্পটিকে যেন দৃশ্যপটে নিপুণভাবে স্থান গড়ে দেয়। তার লেখনীতে খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস উঠে আসে। মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে। প্রখ্যাত বাংলাদেশি লেখক হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটানোর সময় হারুকি মুরাকামির বই পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিখে গেছেন মুরাকামির কাজের সঙ্গে তার কাজের খুব মিল। হুমায়ূন আহমেদ আর হারুকি মুরাকামি দুজনের লেখাতেই আবেগের স্পষ্ট আধিপত্য লক্ষ করা যায়। তার গল্পগলো এগোয় খুবই সাবলীলভাবে, বর্ণনার সঙ্গে। শেষ হয় এক গভীর হাহাকার দিয়ে। তার বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ের নাম ‘আ ওয়াইল্ড শিপ চেইস’, ‘নরওয়েজিয়ান উড’, ‘দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রোনিকেল’, আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ, আফটার ডার্ক। মুরাকামির নায়কেরা আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন। তারা পরীক্ষা-নিরাক্ষা করেন ভালোবাসা, হারিয়ে যাওয়া, আধ্যাত্মিকতা, স্বপ্ন, সংগীতের শক্তি, মুক্তি, লৈঙ্গিক পরিচয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।
মুরাকামি অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ঐতিহ্যের বিষয়টিও পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত এবং তার উপন্যাসের বিষয়গুলোও নেওয়া হয়েছে তার প্রিয় লেখক এবং সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকে। জাপানি কল্পকাহিনীর চেহারা তিনি পরিবর্তন করে ফেলেছেন। জাপানি সাহিত্যে তিনিই প্রথম পশ্চিমা প্রভাব ঢুকিয়েছেন যা জাপানি পাঠকরা এর পূর্বে কখনো দেখেননি। ‘অ্যা ওয়াইল্ড চেইস শিপ’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই বেনামি একজন চেইন ধূমপায়ীকে বর্ণনাকারী হিসেবে। বর্ণনাকারীর জীবন হতাশাজনক এবং সেখানে কোনো ধরনের শুভ অগ্রগতির চিহ্ন দৃশ্যমান নয়। তবে, ঘটনা যখন সামনের দিকে আগাতে থাকে, অদ্ভুত সব ঘটনা তখন ঘটতে থাকে। বর্ণনাকারী একটি অদ্ভূত সুন্দর কর্ণের অধিকারী একটি মেয়ের সঙ্গে ডেটিং শুরু করেন। তিনি ‘দ্য র্যাট’ নামক এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি চিঠি পান। এই বন্ধু গত পাঁচ বছর আগে শহর ছেড়ে চলে যান এবং তার কোনো ধরনের চিহ্নমাত্র খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বইটি মুরাকামিকে সুপারস্টারের মর্যাদা এনে দিয়েছে। এটি ভালোবাসা ও হারানোর গল্প। তরু ওয়াটানাবে নিজেকে কলেজের একজন নবীন ছাত্র হিসেবে দেখছেন। দুজন সুন্দরী ও অস্বাভাবিক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে এখানে।
এটি মূলত একটি বাস্তব ও জটিল ভালোবাসার গল্প। সুন্দরী রমণীদ্বয় হচ্ছেন ’নেওকো’ ও ’মিদরি’। বইটির শিরোনাম নেয়া হয়েছে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের বিটলেসের একটি গান থেকে, যার নাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’ (দ্য বার্ড হ্যাজ ফ্লোন, পাখীটি উড়ে গেছে)। এটি উপন্যাসটির বর্ণনায় বারবার এসেছে। সঙ্গে এসেছে পশ্চিমা সংগীত ও সাহিত্য। ১৯৬০-এর দশকে এটি সংঘটিত হয় টোকিওতে। এটি পরিবর্তিত জাপানের চিত্র তুলে ধরে। শিক্ষার্থীরা ইস্টাব্লিসমেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। মুরাকামি ছাত্র আন্দোলনকে সাদামাটা হিসেবে দেখিয়েছেন। তরু ওয়াটানাবে ‘হিস্ট্রি অব ড্রামা’ ক্লাসে এক উচ্ছ্বল তরুণীর সাক্ষাৎ পান। তার নাম মিদোরি। তিনি তরুর নোট ধার চেয়েছেন। যদিও তিনি খুব একটা সময়ানুবর্তী নন। তার নোট ফেরত দেয়ার তারিখ বারবার পরিবর্তন করছিলেন। তারপরেও তরু তার প্রতি আকৃষ্ট হন, তার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা দুজনেই একে অপরকে সময় দিয়ে যাচ্ছেন এমনকি তরু যখন তার ভালোলাগার আরেক মেয়ে নাওকোকেও চিঠি লিখে যাচ্ছেন তার মধ্যেও তাদেও দু’জনে একে অপরকে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে গল্প চলছে। এক বিকেলে মিদোরি তরুর জন্য দুপারের খাবার রান্না করেন। খাওয়া-দাওয়ার পর দু’জন ছাদে গিয়ে ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে দু’জন ‘চুমো খান’। তরু তাকে খুলে বলেন, তাকে তার ভালো লাগে কিন্তু তিনি এক আবেগঘন ও জটিল রোমান্টিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। মিদোরিও বললেন, তারও একটি ছেলে বন্ধু রয়েছে, অতএব দুইজনই শুধু বন্ধুই থাকতে চান, সম্পর্ক অন্য কোনোদিকে নিয়ে যাবেন না। একদিন কথা বলার একপর্যায়ে মিদোরি হঠাৎ আবগেঘন হয়ে পড়েন এবং চিৎকার করেন। পরে তার রুমমেট রেইকো, তরু ও তিনি বিকেলে ঘুরতে বের হন। রুমে ফিরে এসে নেওকো তার হঠাৎ আবেগী হওয়ার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তারা তিনজনই ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নেন। মধ্যরাতে নেওকো তরুর বিছানার কাছে চলে আসেন, তার পোশাক খুলে ফেলেন এবং তার উলঙ্গ দেহটাকে তরুর কাছে সমর্পণ করেন।
পরদিন সকালে তাকে মনে হচ্ছে কিংবা তিনি ভান করছেন, রাতের কোনো ঘটনাই তার মনে নেই কিংবা রাতে কিছুই হয়নি। সেদিন ‘রেইকো’ ও নেওকো দুজনেই তরুকে পাহাড়ের মধ্যে হাঁটতে নিয়ে যান। পথিমধ্যে রেইকো কফি খাওয়ার জন্য একটি দোকানে থামেন এবং তরু ও নেওকোকে একান্তে কিছু সময় কাটানের জন্য বলেন। পরে বনের মধ্যে হাঁটতে শুরু করেন এবং কথা বলতে বলতে নেওকে তার হাত ব্যবহার করেই তরুকে উত্তেজনার চড়ম সীমায় পৌঁছে দেন। পরে এটিও জানা যায় যে, নেওকোর বোনও তরুণী বয়সে আত্মহত্যা করে মারা যান এবং নেওকো তার দেহ খুঁজে বের করেন। তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে তরুকে পীড়াপীড়ি করছেন তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য জীবন শুরু করতে। কারণ তিনি ভালোবাসার আঘাতে এত জর্জরিত যে, অন্য কাউকে চিন্তা করতে পারছেন না। কিন্তু তরু বলছেন, তিনি তার অপেক্ষায় থাকবেন। ওই রাতে তরু ও রেইকো আবার হাঁটতে বের হয় এবং রেইকো তার গল্প শেষ করেন। ‘দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রোনিকেল’ মুরাকামির আর একটি উপন্যাস যেখানে অন্য একটি জগৎ প্রতিফলিত হয়েছে। এবার গোলক ধাঁধার একটি হোটেলকে নেওয়া হয়েছে পটভূমি হিসবে, যেখানে নায়কের স্ত্রী কুমিকোকে তার শয়তান ভাই বন্দি করে রেখেছেন। ভাইয়ের নাম ওয়াতিয়া নবোরু। নায়ক হচ্ছেন নরম মেজাজের বেকার ঘরে থাকা স্বামী। নাম ওকাদা তরু। তিনি এই পরলৌকিক গোলকধাঁধার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেন। তিনি নবোরুকে মোকাবিলা করে তার স্ত্রী কুমিকোকে উদ্ধার করেন।
হারুকি মুরাকামি একজন জাপানি লেখক কিন্তু তার লেখা সর্বজনীন। তিনি তার লেখায় শুধু জাপানি সংস্কৃতির কথাই তুলে ধরেননি, গোটা মানবজাতির দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা, মানসিক সমস্যা, জটিলতা ও প্রশ্ন নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। তাই তিনি সর্বজনীন। অন্যদিকে তার লেখা একেবারেই জীবনমুখী।
আজকালের খবর/আরইউ