অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারি এবং মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকরের উদ্যোগে দেশের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন, রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) প্রথম জাতীয় কাউন্সিলে অংশ নিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এসময় তারা বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য এখন ঊর্ধ্বমূখী, এত বড় সংকটের মধ্যেও একটা সরকারি নির্দেশে যারা ১০০টি পণ্যের ওপর হঠাৎ করেই কর ও ভ্যাট বাড়িয়ে দিতে পারে, যারা টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ করে নিরন্ন-বুভুক্ষু মানুষের অন্ন জোগানোর পদ্ধতি বন্ধ করে দিতে পারে, বুঝতে হবে যে তারা খুবই থিওরিতে চলে। থিওরির চেয়ে বড় যে প্রাত্যহিক জীবন, সেই জীবন বোঝে না। তারা অর্থনীতির ভালো ভালো সংজ্ঞা বোঝে, কিন্তু অর্থনীতি যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার হিসাব নিকাশ, সেটি বোঝে না। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ বড় কষ্টে আছে।’
মূলত, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে মানুষের বাস্তব তথ্য চিত্র্য ওঠে এসেছে। এ পর্যায়ে আরেক নেতা বলেন, ভ্যাট, ট্যাক্স, দ্রব্যমূল্য ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে পুরোনো ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। এটি কখনো মানুষের জন্য মঙ্গল জনক হতে পারে না।
জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে টিসিবির ট্রাকসেল চালুর দাবি সংগঠনটির। অন্যদিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পক্ষ থেকেও দ্রুত ভ্যাট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। এসময় বলা হয়েছে- ভ্যাট বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এর ফলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে। এ ছাড়া অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ মানুষও সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করছে। এতে করে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে করে কর্মসংস্থানের জায়গা আরো সঙ্কুচিত হয়ে হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট মহলের।
অবশ্য এসব রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসার খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার তার রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য করের আওতা বাড়াবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য যাতে না বাড়ে সে দিকে নজর দেয়ার। একই সঙ্গে বিগত অবৈধ সরকারের দুর্নীতি ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত দেশে এনে তা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যয় করার তাগিদ দেন। অথচ আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত হিসেবে কয়েকটি ধাপে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অন্তর্বতী সরকার সম্প্রতি ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট আরোপের অধ্যাদেশ জারি করে।
এ পর্যায়ে নাগরিক কমিটির প্রস্তাব হচ্ছে, সরকার করের আওতা বাড়াতে পারে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না। বিদ্যমান করের কাঠামোয় যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয় বাড়বে। বিগত সরকার বিদেশে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে বলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। সেগুলো দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে ও খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। এগুলো আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত (২০০৩) সরকারকে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করার যাবতীয় আইনি সুযোগ দিয়েছে। সরকার এ সুযোগ ব্যবহার করে দ্রুত একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খেলাপি অর্থ আদায় ও অনাদায়ে তাদের সম্পত্তি ক্রোক করতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও করপোরেট কর বাড়িয়েছে সরকার। অংশীদারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছে ডিসিসিআই। রাজধানীর মতিঝিলে সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ডিসিসিআই। সংবাদ সম্মেলনে, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, ডলারের দাম বেশি। গণঅভ্যুত্থানের পর বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঋণের সুদহারও অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির গতি কমিয়ে দেবে। এতে চাপে পড়বে আপামর জনগন।
সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা ঠিক না রাখায় ব্যবসার চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে নীতির ধারাবাহিকতা ঠিক না রাখার সর্বশেষ উদাহরণ হলো গত সপ্তাহের এই ভ্যাট বৃদ্ধির ঘটনা। মোটরসাইকেল ও ইলেক্ট্রনিকস খাতের কিছু পণ্যে আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের শুধু বিপদে ফেলবে না, একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিকেও খারাপ করছে। আয়কর বাড়ানোয় আগামী তিন মাসের মধ্যে মোটরসাইকেলের দাম ১০-১৫ শতাংশ বাড়তে পারে। মানুষকে কষ্ট দিয়ে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকারকে অন্য উপায় খোঁজার পরামর্শ তাদের। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় ২০ শতাংশ কমানো গেলে সেখান থেকে এক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় করা সম্ভব। সুতরাং সরকারি ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর দিকে সরকারকে অগ্রসর হওয়ার তাগিদ। দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপথ আলাদা থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ডিসিসিআই নেতারা। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসার পরিবেশ খারাপ করেছে। তাদেও মতে, ‘অর্থনীতি ও রাজনীতি’ একই পথে যেন না চলে। রাজনীতি রাজনীতির মতো করে , সেটি যেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত না করে।
অন্যদিকে, শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারি হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মাঝে। তারা বলছেন, পুঁজির ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, সুদের উচ্চহার, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় অনেক দিন ধরেই দেশের শিল্প-কারখানার চাকা গতি হারিয়েছে। কঠিন সময় পার করছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অনেকটাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে আসে স্থবিরতা। সেই পরিস্থিতি এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এখনো স্বস্তি আসেনি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। উপরন্তু অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে শতাধিক পণ্য-সেবার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শিল্পের বিকাশ স্থবির হয়ে পড়বে, বাধাগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থান। দীর্ঘমেযাদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু’র অভিমত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হবে না। দেশের মানুষ এখনো জানে না রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এখন নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছেন। গ্যাসের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে করে শিল্পখাতের উৎপাদন ও রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এরইমধ্যে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে আবার শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। ভ্যাট ও করারোপের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে আরেকদফা বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এখন বাড়তি শুল্ককর গুনতে হবে। এ অবস্থায় গার্মেন্টস ও প্লাস্টিকসহ কোনো উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। শুল্ক-কর সংক্রান্ত অধ্যাদেশ দ্রুত প্রত্যাহার ও গ্যাসের দাম কমাতে হবে। এখন প্রয়োজন শিল্পের বিকাশ, যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক না কাটলে সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যবসায়ে গতি আনতে ব্যবসাবান্ধব নীতি ও পরিবেশ প্রয়োজন, যাতে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলে।
অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিমত, বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ১০০টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামে কোনো বড় প্রভাব পড়বে না।
বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন আইএমএফের শর্ত পুরনে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হয়ে গেল। কারণ যেসব পণ্যের শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশই সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ এবং প্রতিটি পণ্যেরই দাম বেড়ে যাবে অত্যধিক। এতে কষ্ট বাড়বে ভোক্তাদের। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আইএমএফের ফাঁদে পড়েই বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দেশের মানুষের কথা না ভেবে অর্থনৈতিক নীতি ঠিক করেছে, তেমনিভাবেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও আইএমএফের পরামর্শে শতাধিক পণ্যের শুল্ককর বাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের অভিমত, এভাবে একসঙ্গে শতাধিক পণ্যের শুল্ককর বাড়ানো সরকারের খুবই দায়িত্বহীন কাজ হয়েছে। শুধু দায়িত্বহীনতা নয়, এ ধরনের কাজ সরকারের বড় ভুল। এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর, অর্থনীতির ওপর, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে কতটা পড়বে সেটি আগে বোঝার দরকার ছিল। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সরকার মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে শতাধিক পণ্য ও সেবায় আরোপিত বাড়তি শুল্ককর হ্রাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় নেবেন। নতুবা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কষ্ট, ব্যয়, দুর্ভোগ বাড়বে। নিশ্চয় তা কারো কাম্য নয়। বরং এ ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবায় বাড়তি শুল্ক করের পরিবর্তে ভ্যাট ও আয় কর এবং রাজস্ব আদায়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, হয়রানী বন্ধ করে রাজস্ব আদায়ের পথ সহজ ও সুগম করলে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ