একবার আটঘাট বেঁধে বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার ক্রিকেট খেলা দেখতে বসেছি। সবেমাত্র খেলা শুরু হবে, বউ এসে বলল, আজ যে তোমার একটা দাওয়াতে যাওয়ার কথা সেটা কি খেয়াল আছে?
আমার মনে পড়লো, আজ আমার চাচাতো শালার জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা।
আমি বললাম, বাদ।
বউ বলল, কি বাদ? খেলা দেখা?
না। মেয়ে দেখতে যাওয়া বাদ।
বউ চোখ গরম করে বলল, অসম্ভব, অনেক দিন আগে থেকেই তারিখ দেওয়া আছে। আজ না গেলে হবে? সবাই কি মনে করবে? মনে রেখ, তোমার জন্য আরো দুইটা তারিখ পাল্টাতে হয়েছে।
আমি বললাম, দুনিয়া কেয়ামত হয়ে গেলেও আজ মেয়ে দেখতে যাওয়া সম্ভব না। আজ ইন্ডিয়াকে যেকোনো উপায়ে হারাতেই হবে। ইজ্জত কা সওয়াল!
আমার কঠিন গলা শুনে বউ আহ্লাদী গলায় বলল, তুমি আমার কথা শুনবে না?
বুঝলাম ধমক খেয়ে বাঘ বিড়াল হতে শুরু করেছে, পাত্তা দিলে বিড়াল আবার বাঘ হয়ে যেতে পারে। তাই বললাম, তোমার কথা তো বহুদূর! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এসে বললেও আজ কাজ হবে না। বাংলাদেশের আজ বাঁচা মরার লড়াই!
লক্ষীটি! তুমি আমার কলিজার টুকরা...
আমি ধমক দিয়ে বললাম, রাখো তোমার কলিজার টুকরা! অন্য সময় তো লোহার টুকরা, নিদেনপক্ষে একটা কাঠের টুকরা বলেও ডাক দেও না!
বউ মিশাইল ছোড়বার চেষ্টা করলো, আজ যদি আমার কথা না শোন তবে আমার মরা মুখ দেখবা...
দূর! দূর! আমি তোমার মরা মুখ জীবনেও দেখবো না, জীবিত মুখই ঠিক মতো দেখতে চাই না, আবার মরা মুখ দেখবো! ছ্যা ছ্যা!
এইবার ছুড়লো শেষ অস্ত্র, আমি কিন্তু বাপের বাড়ি চলে যাবো।
আমি খুশি খুশি গলায় বললাম, হু কেয়ারস! যাওয়ার আগে এক কাপ গরম চা দিয়ে যাও আর রাতের খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে যাও। জানো তো, আমি আবার বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি না। আরেকটা কাজ করতে পার, এক বোতল মদ...
বউ অবাক হয়ে বলল, মদ দিয়ে কী হবে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তুমি যখন চলেই যাচ্ছো, বাসা তো খালি। জীবনে কখনো মদ ছুঁয়ে দেখি নাই, তুমি চলে যাবে সেই আনন্দে...
বউ এবার লাইনে এলো, নরম গলায় বলল, আচ্ছা, এই ক্রিকেট খেলা দেখে কী মজা পাও? শুধু হাতে কাঠ নিয়ে বাইরাবারি আর দৌড়াদৌড়ি! কোনো সুস্থ মানুষ এসব করে?
বউ ক্রিকেট, ফুটবল খেলা বোঝে না। সে শুধু দুইজন খেলোয়াড়ের নাম শুনেছে। ম্যারাডোনা আর শচীন টেন্ডুলকার। তাও খেলা দেখে নয়, মানুষের মুখে শুনে শুনে।
তার একমাত্র শখ টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান দেখা। নতুন নতুন আইটেম শিখে সেগুলো আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার একমাত্র কাজ। একটা আইটেম রাঁধবে আর আমাকে বলবে, দেখ তো, খাবারটা চমৎকার হয়েছে না? আমি পৃথিবীর নিকৃষ্ট খাবারটা মুখে দিয়েও বলি, আহ, সুপার হয়েছে! তোমার হাতের কাজ তো অসাধারণ!
একবার ভুল করে বলে ফেলেছিলাম খাবার ভালো হয়নি। তিনদিন আমাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। বাসায় সব রান্না বন্ধ! কী দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে পেটে গ্যাস্ট্রিক আলসার বাড়ানোর?
বউ কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইল, তারপর খুবই করুণ গলায় বলল, সবাই বউয়ের কথা শুনে, শুধু তুমিই আমার কথা শোন না!
আমি খেলা দেখতে দেখতে বললাম, কে বলল, শুনি না? এক মনিষী বলেছে, সব সময় বউয়ের কথা শুনে চলতে হয়, তা না হলে বিপদ!
কী বিপদ?
বউয়ের কথা না শুনলে খাবার রান্না করে সেই খাবারে পাঁদ দিয়ে রাখতে পারে!
কথা শুনে বউ চোখ গরম করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর রাগী গলায় বলল, তাহলে তুমি যাবে না?
আমি দৃঢ় গলায় বললাম, না, প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যাবো, এই ঘরে আজ রক্তারক্তি হয়ে যাবে, রাম দা নিয়ে কোপাকোপি হবে, তবুু আমার কথা নট নড়নচড়ন!
এসব বলে লাভ হবে না। আমি তোমার কাপড় ইস্ত্রি করে আনছি, তুমি রেডি হও।
বলেই চলে গেল।
বউ চলে যেতেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। খেলা জমে গেছে। যতোই জারিজুরি করি, বউয়ের কথা না শুনলে খবর আছে। বউ হচ্ছে ঘরের প্রধানমন্ত্রী, আমরা ঘরের চৌকিদার। প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটা চৌকিদার কবে কোথায় পেরেছে?
নাহ! একটা শক্ত অজুহাত দাঁড় করাতে হবে। কী করা যায়? কীভাবে না গিয়ে বাঁচা যায়?
ইন্ডিয়া ব্যাট করছে। বোলিং করছে মোস্তাফিজ। মোস্তাফিজের একটা বল রোহিত শর্মার ব্যাটের কোনায় লেগে উপরে উঠে গেল। তামিম দৌড়ে গেল ক্যাচ ধরার জন্য। নিশ্চিত ক্যাচ জেনে আমি চিৎকার করে আউট বলে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর হতাশ হয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়লাম। তামিম সহজ ক্যাচ মিস করেছে!
বউ ইস্ত্রি করা ফেলে চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে আমি সোফায় পড়ে আছি! বউ বলল, কী হয়েছে?
আমি বললাম, তাড়াতাড়ি প্রেশারের ট্যাবলেট দাও, উত্তেজনায় প্রেশার বেড়ে গেছে!
বউ দৌড়ে গিয়ে অন্য রুম থেকে ট্যাবলেট নিয়ে এলো। ওষুধ খেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছি, এমন সময় কাপড় পোড়া একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বউকে বলতেই ভোঁ করে দিল একটা দৌড়!
ওমা! বউ দৌড়ায় কেন?
কিছুক্ষণ পর হতাশ মুখে বউ সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ঈদে কেনা আমার শখের দামী পাঞ্জাবি। সামনে এনে মেলতেই দেখা গেল মাঝখানে জানালার মতো হয়ে গেছে। সেখান থেকেই পোড়া গন্ধ আসছে। পাঞ্জাবিটা কিনে আমি শুধু ঈদের দিন একবার পরেছি!
ভিতরে ভিতরে আমি এতো খুশি হলাম যা বলার না! যাক, বউকে ঘায়েল করার একটা অস্ত্র পাওয়া গেছে। এটাই হবে বউকে ঘায়েল করার মোক্ষম সুযোগ!
আমি প্রথমে গম্ভীর মুখ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম, তারপর ভীষণ রাগী রাগী চেহারা নিয়ে বউয়ের দিকে তাকালাম। বেচারা অপরাধী মুখ নিয়ে বসে আছে। আমি নিশ্চিত এখন আর দাওয়াত ফাওয়াতে যেতে বলবে না।
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেলা দেখতে লাগলাম। ইন্ডিয়া দেদারসে পিটিয়ে যাচ্ছে। আমি হা হুতাশ করছি। একবার উঠছি আবার বসছি। ক্যাচ মিস করার জন্য তামিমকে দায়ী করছি। টিভিতে বারবার রিপ্লাই দেখাচ্ছে, তামিম কীভাবে সহজ ক্যাচ মিস করেছে।
কিছুক্ষণ খেলা দেখে বউ বললো, বাংলাদেশ একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে।
আমি টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম, কী ভুল?
বউ বিশেষজ্ঞের মতো করে বলল, ইন্ডিয়া একটা শক্তিশালী দল। এই দলের বিপক্ষে তামিমরে নামানো ঠিক হয় নাই।
আমি বললাম, তাহলে কাকে নামানো উচিত ছিল?
ম্যারাডোনারে। পয়সা একটু বেশি খরচ হইতো, তবু ম্যারাডোনারে হায়ার কইরা আনলে বাংলাদেশ নিশ্চিত জয় লাভ করতো! বাংলাদেশ বিরাট ভুল করছে!
বউয়ের কথা শুনে আমার মুখ থেকে কোঁৎ করে একটা শব্দ হলো।
বউ বলল, আবার কী হলো?
আমি বললাম, যদি তোমার জামাইরে জীবিত দেখতে চাও, তবে দৌড়ে গিয়ে আরেকটা প্রেশারের ট্যাবলেট আনো!
খেলা বিশেষজ্ঞ বউ আমার ট্যাবলেট আনতে দৌড় শুরু করলো!
ভাবছি, কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হইছে। এইবার জানি কোন দলে শচীন টেন্ডুলকারকে নামিয়ে দেয়!!
আজকালের খবর/আরইউ