ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্টেও বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে প্রোগ্রেস বা অগ্রগতির জন্য। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার ‘বিশ্বের এক নম্বর দেশ’ হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু সেসবের প্রায় সবই দুর্নীতি বা দুর্যোগের জন্য। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকীটি ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও নতুন দিকে দেশের যাত্রা শুরু করার বিষয়টিই বাংলাদেশকে তালিকার শীর্ষে নিয়ে এসেছে। বিজয়ী বাংলাদেশ এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। গত আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথের আন্দোলনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশটিকে ১৬ বছর ধরে শাসন করেন। দেশের স্বাধীনতার একজন নায়কের কন্যা হাসিনা। একসময় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পরে দমনপীড়ন শুরু করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি করেন, বিরোধীদের কারাগারে ভরেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তার আমলে বিরাট অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার শাসনবিরোধী গণজাগরণের ফলস্বরূপ তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের শাসক হিসেবে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার শাসনকালে দেশটি একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে গেলেও, অন্যদিকে নানা দমন-পীড়ন, নির্বাচন কারচুপি ও বিরোধী নেতাদের কারাবন্দি করার মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শেখ হাসিনার শাসনকালে নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে। বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণি। যেখানে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের। যোগ্যতা বা মেধা নয়, একটি মাস্তানচক্র নানা ধরনের প্রপাগান্ডা চালিয়ে তথাকথিত স্মার্ট বাংলাদেশের শ্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাটের সাথে জড়িত ছিলেন। এদের সাথে ছিলো একটি ব্যবসায়ী অলিগার্ক শ্রেণি ও প্রশাসনের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে পুলিশ, বিজিবি ও বেসামরিক আমালতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির একমাত্র যোগ্যতা ছিলো ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা। বিচার বিভাগে নিষ্ঠুর কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো যত বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে ফাঁসি প্রদান করা। পদোন্নতি ও সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হয়ে উঠেছিলো কে কত বেশি ফাঁসির রায় দিতে পারবেন। এই ঘটনা জেলা আদালত, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দেখা গেছে। আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নমূলক শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিচার ও আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। সামগ্রিকভাবে একটি রক্তপিপাসু পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিলো। প্রত্যকটি হত্যকাণ্ড ও নিপীড়নের পক্ষে শেখ হাসিনার সাফাই ছিলো ভুক্তভোগীরা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করেছিলেন সেখানেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির কথা বলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে গেছেন। দিয়েছেন অন্যায় ও অপকর্মের অবাধ লাইসেন্স। এই বিভাজনের কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ-কিশোর ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণরা শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতির কৌশলটি শুরুতেই ধরে ফেলেছিলেন। এ কারণ তারা সব মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের একত্রিত করতে পেরেছিলেন। সেখানে একমাত্র পরিচয় ছিলো ছাত্র। ফলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এক সময় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কারণ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এটি এমন এক আন্দোলন যেখানে বিভক্তি ও বিভাজন নেই। ডান-বাম, ইসলামপন্থি সবাই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে। ফলে জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনার শাসনের পতন তরান্বিত হয়ে উঠে। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে আমরা এবার প্রথমে দেখেছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এক সাথে অংশ নিতে। বাংলাদেশের রাজনীতি যে বিভাজনের ধারায় চলছিলো সেখানে ছাত্ররা সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের সফলতার প্রধান শক্তি ছিলো ছাত্রদের এই দূরদর্শী কৌশল ও নীতি। আমরা রাজপথে অনেক বিরল দৃশ্য দেখেছি। হিন্দু-মুসলিম, দাড়ি টুপি হিজাবি- নন হিজাবি সব মত পথের ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখেছি। এই ছাত্র আন্দোলনে কয়েক জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী প্রাণ উৎসর্গ করেছে। আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো নারীর অংশগ্রহণ। অতীতে বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনে রাজপথে নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিলো আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে তাদের রাস্তায় নামা থেকে বিরত রাখা। এ কারণে তিনি নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে শেখ হাসিনার সব কৌশল ব্যর্থ করে দেয়। তার নির্দেশে যত বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে তত বেশি মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। নারীরা তাদের সন্তানদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রীরা আরো বেশি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। তারা বুঝতে পারে তাদের ভাইদের হত্যা ও নিপীড়ন ঠেকাতে হলে শেখ হাসিনার বিদায় ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি হয়ে উঠে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র- জনতার আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনা তার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিলো ভয় দেখানো। এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত এবং তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তিনি ভেবেছিলেন দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, তার পিতা ও তার পরিবার এ দেশের মানুষকে একটি রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। ফলে গণভবনে বসে এই দেশ শাসন করার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে তার পরিবারের। তিনি কার্যত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি জমিদারিতে পরিণত করতে চেয়েছেন, যার একমাত্র শাসক হচ্ছে তার পরিবার। ফলে তার পতনের সাথে সাথে মানুষের আক্রোশের প্রকাশ ঘটে গণভবনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে। পতনের উল্লাস প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষের ওপর নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দিয়ে তারা পরিবার বিদেশে বিলাসি জীবনযাপন করে গেছেন। তার পুত্র যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে স্থায়ী হয়ে গেছেন। তার বোনের পরিবার লন্ডন ও ইউরোপে স্থায়ী হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, তিনি ও তার বোনের পরিবার এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু খবর ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে সম্পদ হিসাব দেওয়া নিয়ে তদন্ত চলছে। এর আগে শেখ রেহানার লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি কেনার নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পদ নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়ে তার বাবা ও পরিবারকে বাংলাদেশের একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করেছিলেন। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
মেয়াদ স্বল্প বা দীর্ঘ যা-ই হোক, বিপ্লবের আগে-পরের দুই সরকার ও শাসকদের পারফরম্যান্সের তুলনা করা যেতেই পারে। গণবিরোধী ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার, হত্যা ও গুম, জুলুমশাহি, গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, ভোট চুরি, রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান নষ্ট-এসব কাজ কোন আমলে সংঘটিত হয়েছে? মানুষের ধারণা ও বোঝাপড়া, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও ন্যায়পরায়ণতার সূচক দিয়ে যে কেউ এটা বিশ্লেষণ করতে পারেন। হাসিনা এখন অতীত। তার শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপ্লবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। এই সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন, একঝাঁক সদস্য নিয়োগ এবং ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এক দশকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সরকার ক্ষমতা সুসংহত করতে পেরেছে, এমনটি মনে হয় না। আমলাতন্ত্র ও বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা তার নজির। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সেবাপ্রাপ্তিতে দুর্নীতির উপস্থিতি এবং আওয়ামী আমলে অর্জিত অবৈধ অর্থসম্পদ উদ্ধারে ব্যবস্থা না নেওয়া, চলমান শাসনের বিচ্যুতিই প্রমাণ করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যেমন খুব আস্থাশীল হওয়া মুশকিল, তেমনি উন্নতি দেখা যায় না ব্যবসায়িক পরিবেশেও যেখানে উদ্যোক্তা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ হতে পারতেন ইতোমধ্যেই। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য রাজনৈতিক সংস্কার আনার অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক ঝুটঝামেলাও আছে। সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। বিভক্তির জায়গাগুলোয়ও নজর দিতে হবে। যদি রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংস্কারপ্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তবে এ মুহূর্তে সবকিছুই সম্ভব। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। ইউনূস সরকারের উদ্যোগগুলো, বিশেষ করে সংস্কার কার্যক্রমকে, টেকসই বা কালজয়ী করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতি ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা কিছুটা অনিশ্চয়তা মানুষকে আশাহত করে। প্রফেসর ইউনূসের সরকার, তার উপদেষ্টাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যে শুধু অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজ করবেন তা নয়; তারা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করবেন, এমনটিই কাক্সিক্ষত। শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকেরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিলে তাতে তার ও বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তার সরকার রাজনৈতিক অনাস্থার মুখে যদি প্রস্থানের পথ খোঁজে, তাহলে তা জাতির জন্য অমঙ্গলেরই হবে। ফ্যাসিবাদের বিষবৃক্ষ ও তার ডালপালা গজানোর ভবিষ্যৎ সুযোগ থাকা মোটেও কাম্য নয়। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূস সরকারের জন্য নিজেদের কর্মের মূল্যায়ন ও নতুন ভাবনা যুক্ত করাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য চাই।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। এটি ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন পেয়েছে। এ সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছে। মর্যাদার আসনে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ । এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক। গণতন্ত্রায়ণ ও সুশাসনের পথে অগ্রসর হওয়ার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষ নিয়েছে, সে কারণেই বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে এই শিরোপা তাদের জুটেছে। বাংলাদেশের মানুষ জয়লাভ করেছে এমন এক জগদ্দল, আপাত-অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যার অপসারণ ৫ আগস্টের কয়েক সপ্তাহ আগেও অসম্ভব মনে হয়েছিল। অসম্ভবকে পরাস্ত করতে চাই সাহস, মৃত্যুকে অস্বীকার করার মতো অবদমিত মনোবল। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না আমরা, কিন্তু আশার কথা, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশটি ইতোমধ্যেই স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে অগ্রগতি অর্জন করেছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতে পূর্বের অরাজকতা দূর হয়েছে। দেশটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে একত্রে, বাংলাদেশের এই সাফল্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর অর্জিত হয়েছে। এই অস্থায়ী সরকার শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল করেছে। একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং আরো উদার সরকার গঠনের পথে অগ্রসর হওয়া জন্য ২০২৪ সালের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিবর্তন, তা আসলে অগ্রগতি কি নয়, তা নিয়ে এখনো কোনো কোনো মহলে জিজ্ঞাসা রয়েছে। বিগত স্বৈরশাসনকালে যাঁরা সরাসরি অথবা অপ্রত্যক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন, তাদের জন্য শেখ হাসিনার পলায়ন মাথায় বাজ পড়ার মতো ঘটনা। তারা যে এখনো এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছেন না, সেটিই স্বাভাবিক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ