আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ড পরামর্শ্যরে জন্য ব্যবসায়িদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতর অধিদফতর থেকেও তাদের চাহিদা, সম্ভাব্য পরামর্শ নিয়েছে। কিন্তু বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় এবারের বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের সঙ্গে নতুন করে ইরানের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ইতোমোধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন; ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য সংকট মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে।
ইতোমধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জন্য দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিয়েছে এনইসি। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
মূলত বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা উন্নয়নশীল দেশে দিনের শেষে বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের বাষিক হিসাব। তবে এতে কিছুটা উন্নয়ন অর্থায়নের পরিকল্পনা, সাধারণ জনগণকে কিছুটা আশ্বস্ত আর কিছুটা সহায়তা করার পরিকল্পনাও থাকে। বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে গুণগত মান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রচেষ্ঠায় বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়। তবে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মাঠপর্যায়ে তহবিল বা বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে।
প্রসঙ্গত বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ালেও করোনা পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরো সুদৃঢ় ও জোরদার এবং চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নের প্রত্যাশা করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। রাজস্ব বোর্ড এবং এফবিসিসিআই’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এই প্রত্যাশার কথা জানায় এফবিসিসিআই।
প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জনমুখী ব্যবসা-বান্ধব বাজেট প্রণয়নে প্রয়োজন করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত এআইটি, আগাম কর প্রভৃতি প্রত্যাহার করা। ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে ও পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করার বিষয় গুরুত্বসহ দেখা দরকার। একই সঙ্গে কর কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা দরকার। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না করার প্রস্তাবও আসে বৈঠকে। মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে- আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে চার লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব আসে।
বাজেট প্রণয়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত বিশ্ব পরিস্থিতি এখন টালমাটাল। এমনি অবস্থায় মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, বহুমুখীকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সন্ধান, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাসমূহের আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সকল ধরনের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর নিশ্চয়তার পাশাপাশি কর আদায়ে হয়রানি ও জটিলতা নিরসন দরকার। কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবা খাতে করের যৌক্তিক নির্ধারণ দরকার। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- বিশেষ করে চাল, গম, আলু, পিঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভূট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনিসহ সকল প্রকার কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহিভূর্ত রাখার বিষয়ে ভাবতে হবে।
ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই বলেছেন আমরা সঠিক পথে আছি। কী কী সমস্যা আছে, তা সবাই জানেন। তারপরও তারা তাদের মতো করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে বলে মত দিয়েছেন।’ আগামী বাজেটে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার যে সমস্যা চলমান আছে, সেটি দূর করতে হবে। অবশ্য সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধিকারগুলো যেন যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়, সেটি বলেছি। খেলাপি ঋণ কমানো, বিদেশি ঋণ কম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বৈঠকে।’ তিনি ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ‘বর্তমানে দেশে আয়বৈষম্য উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আয়বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি আমি। এ ক্ষেত্রে ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কর্মসূচিসহ যেসব খাত থেকে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবে, সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’
আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় প্রকল্প কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলেছেন, যে প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগে এবং ফল আসতে দেরি হয়, সে ধরনের প্রকল্প যেন কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীতে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, সেন্সর, অটোমেশন, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন ও প্রকৌশল প্রযুক্তির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই প্রশস্ত আঙিনায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে করণীয়, ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা, পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল তৈরির উপায়, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটে এসব অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা ও তাদের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দক্ষ করে তোলার প্রয়াস সফল হলেই অর্থনীতিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। বর্তমানে দেশে তিন লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারি দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণসহ এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই জন প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ