প্রকাশ: শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪, ৪:১৩ PM
সব্যসাচী বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি রেখেছেন তার প্রতিভার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন বই।
বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে। ২০১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন গুণী এই লেখক। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে।
১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার এক অনন্য মেলবন্ধন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাকে এপার বাংলা ওপার বাংলা এবং সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে তুমুল জনপ্রিয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা।
পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। প্রেম জগতের এক অনন্য অনুভূতি। আর পশ্চিম জগতের একটি প্রেমের কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সোনালী দুঃখ উপন্যাস। প্রেমের ক্ষেত্রে দেশ-কাল-পাত্র এমনকি বৈধ অবৈধ যে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয় এটিই কাহিনীর মূল বিষয়বস্তু। সোনালী প্রেমিকার নাম আর দুঃখ এক অভাগা প্রেমিকের নাম। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রেম কাহিনী সোনালী দুঃখ। প্রেমে নিশ্চিত বিরহ জেনেও সবাই সেই বিরহকে সানন্দে গ্রহণ করে নেয় প্রেমের যমুনায় অবগাহন করে অপার আনন্দে, সীমাহীন মুগ্ধতায়। বইটি লেখা হয়েছে প্রাচীন সেলটিক যুগের এক ট্র্যজেডি কাহিনী নিয়ে। ত্রিস্তান এবং ইসল্ট (সোনালী) এর মধ্যকার প্রণয় এবং একই সাথে বীর ত্রিস্তানের দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ দেখানো হয়েছে এই বইতে। এ উপন্যাসের চরিত্র রাজকুমার ত্রিস্তান (দুঃখ) রাজকন্যা সোনালী চুল ইসল্ট, রাজা মার্ক, রাজা রিভালেন, রাজা মর্গান, রাজকুমার মোরহল্ট, সখী বরজা, রাজকন্যা রুপালী চুল ইসল্ট, গরভেনাল। গল্পের পটভূমি ৯০০ খ্রিস্টাব্দের। এখানে ইউরোপের তিনটি রাজ্য কর্নওয়েল, লিওনেস, আয়ারল্যান্ডকে ঘিরে গল্পের পটভূমি ফুটে ওঠেছে। রাজকুমার জন্মের আগেই তার বাবাকে হারান। জন্মের সময় মাকেও হারান। দুঃখী রাজকুমারের নাম তখন থেকেই দুঃখ। আজীবন বহন করে গিয়েছে দুঃখ। দুঃখই যেন তার সারা জীবনের সাথী।
দুঃখের সাথেই যেন আজন্ম বসবাস। এক সময় রাজকুমার নিজের রাজত্ব ছেড়ে চলে যায় তার মামা মার্কের রাজত্বে। রাজা মার্কের রাজত্বের রক্ষা কবজ হয়ে যায় দুঃখ। রাজা মার্ক ও দুঃখকে ভীষণ ভালোবাসে ও বিশ্বাস করে। মার্কের জন্য একে একে নিজের জীবন বাজি ধরে সব যুদ্ধজয় করতে থাকে দুঃখ। ভালোই যাচ্ছিল দুঃখের সময়। হঠাৎ একদিন রাজা মার্ক পাখির মুখ দিয়ে নিয়ে আসা সোনালী চুল দেখে অতি উৎসাহী হয়ে ঘোষণা করেন, এক সোনালী চুলের মেয়েকেই তিনি বিয়ে করতে চান। রাজার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য সোনালী চুলের মেয়ের খোঁজ করতে নামে ভাগ্নে দুঃখ। শেষে সোনালী চুলের মেয়ের খোঁজ পান দুঃখ। কিন্তু নিয়তির কি বিধান। সোনালী এবং দুঃখ পরস্পরের প্রেমে অকুল ব্যকুল হয়ে উঠে। কিন্তু দুঃখ রাজা মার্কের প্রতি এই অবিচার কিছুতেই করতে পারবে না। বুকে পাথর বেঁধে দুঃখ সোনালীকে রাজা মার্কের হাতে তুলে দেয়। রাজা মার্ক ও সোনালীর বিয়ে হয়ে যায়। রাজা মার্ক তো খুব খুশি।
কিন্তু অন্তরে দুঃখে বিরহে তিলে তিলে শেষ হতে শুরু করে সোনালী আর দুঃখ। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে সোনালী আর দুঃখ গোপনে দেখা করতে থাকে। রাজাও একসময় সেসব কাহিনী জেনে যায়। রাজা ক্রোধে দুঃখকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আর রানিকে কুষ্ঠরোগীদের হাতে সমপর্ণ করে দেয়। দুঃখ নিজে পলায়ন করে এবং রাণীকে কুষ্ঠরোগীদের হাত থেকে রক্ষা করে বনবাসে চলে যায়। সেখানে শান্তিতেই থাকতে শুরু করে দুঃখ আর সোনালী। রাজকুমারী বনে বাদাড়ে পুরাতন ছেঁড়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। দুঃখ ভাবে তার জন্যই রাজকুমারীর এত দুঃখ। রাজকুমারী তো মহাসুখেই ছিল রাজপ্রাসাদে। অন্যদিকে রানি সোনালীও ভাবে তার জন্যই দুঃখের এত দুঃখ। দুঃখ হলো বীর, বীরবেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা রাজ্যে। কিন্তু সোনালীর ভালোবাসার জন্য দুঃখ সব ত্যাগ করে জঙ্গলে পড়ে রয়েছে।
দুঃখ সোনালীর এমন কষ্ট সইতে না পেরে রাজার নিকট সমপর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। রাজা আপনমনে রানিকে গ্রহণ করে। আবার শুরু হয় রাজার সুখের দিন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রানি আর দুঃখের অন্তর তচনছ হতে শুরু করে। বেঁচে থেকেও যেন মৃত। কষ্টের হলেও সত্যি যে সোনালী আর দুঃখের প্রেম পূর্ণ না হলেও তারা কিন্তু এক হতে পেরেছিল। এক হয়েছিল তবে এই মায়ার জগতে না, এক হয়েছিল দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে পরজগতে। দুঃখের শরীরে থাকা বিষ সোনালী ঠোঁট দিয়ে নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দুঃখের সাথে নিজের জীবন বিলীন করে দেয়। লেখক নায়ক চরিত্রকে শুরুর দিকে বীর ও মহত্ত্ব এবং শেষের দিকে দ্বন্দ্ব, দুঃখবোধ ও নির্জনতার চূড়ায় নিয়ে গেছে যা গল্পের প্রতি অন্য এক ভালো লাগা সৃষ্টি করে। বড় বড় যুদ্ধে জয় হলেও সোনালি কে জয় ও মিলন হয় মূলত মৃত্যুতেই।
আজকালের খবর/আরইউ