রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে
ড. মাহবুব হাসান
প্রকাশ: সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:৩০ PM
গত বছরের আগস্টের তুলনায় এ বছর (২০২৪) ভারতের ২৪ শতাংশ রপ্তানি বাংলাদেশে কমেছে। এই তথ্য দিয়েছে ভারতীয় মিডিয়া ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা ভারতীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গত বছর এই সময়ে ভারত বাংলাদেশে রপ্তানি করেছিল ৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ বছর ২০২৪-এ তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে। শতকরা হিসাবে কমেছে মাত্র ২৮ শতাংশ।

একমাত্র তুলা রপ্তানি করে গত বছর ভারত বাংলাদেশ থেকে ১১১ কোটি ডলার নিয়েছে। তুলা খাতে তাদের রপ্তানি কমেছে মাত্র ১০ শতাংশ। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য জানায় যে, গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের উৎখাতে ছাত্রজনতার গণবিক্ষোভের ফলে তেমন কোনো সংকট হয়নি। দাবি করা হয়েছে যে তাদের তুলা ও গার্মেন্ট পণ্য আমদানি কমেছে মূলত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে।

দিনে দিনে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হবে না, এই সত্য আমরা জানি। আর সেটি আমরা চাইও না। ধীরে ধীরে ওই রাষ্ট্রটির অপ্রতিবেশিসুলভ দাদাগিরির চাপ কমিয়ে আনবো আমরা। সুপ্রতিবেশি হতে হলে কেমনতর আচরণ ও বন্ধুত্ব দেখাতে হয় তা বিএসএফের মালিক মোদি সরকার বোঝে না। সীমান্ত হত্যাই কেবল বন্ধ করতে হবে না ভারতকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। 

সত্যই যদি বৈদেশিক মুদ্রার অভাবই মূল কারণ হয়, তাহলে তা তো কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে না বাংলাদেশের। কারণ এর মধ্যেই রেমিট্যান্সের স্রোত লেগেছে। প্রবাসীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেমিট্যান্স-অস্ত্র ব্যবহার করেছিলে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে। ২০২৪-এর জুলাই মাসে মাত্র ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স তারা পাঠিয়েছিল। আর তার আগের মাসে পাঠিয়ে ছিল ২৬৫ কোটিরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।
হাসিনা আগস্টের ৫ তারিখ উৎখাত হয়ে পলায়ন করলেই রেমিট্যান্স পাঠানোর গতি বাড়ে। তখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকা রিজার্ভ তর তর করে বেড়ে এখন ২৪ বিলিয়নের কোঠায়। অতএব ভারত থেকে পণ্য কেনার গতিও নিশ্চয় বাড়বে। এতে মোদি বা ভারতের বিশ্লেষকরা আনন্দিতই হবেন। কিন্তু একটি ব্যাপার ঘটে গেছে ওই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগেই। তা হলো, ভারতীয় মোদি সরকারের হাসিনা-প্রীতিকে তারা পছন্দ করেনি।

বহু আগে থেকেই এদেশের মানুষ ভারতের নকল প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ, ভারত এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্তে বাংলাদেশের চাষীদের গুলি করে হত্যা করে। সর্বশেষ স্বর্ণা দাস নামে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এসব কারণে এদেশের মানুষ মনে-প্রাণে ভারতকে অপছন্দ করে। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন মোদি সরকারের পোষ্য, পেয়ারের লোক। তাই তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে জোড় কদমে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রতিবাদে, প্রতিরোধে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাতের জন্য।

আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কোন কোন পণ্য ভারতের, তা চিহ্নিত করে বলছে এগুলো কিনবেন না। আমরা যেমন কোকাকোলা না খাওয়ার জন্য সবাইকে জানাই। কারণ ওই পানীয়ের মূল উৎপাদক ইহুদি। আর যে দেশেরই হোক না কেন, ইহুদিরা টাকা দেয় ইসরায়েলকে, খুনে নেতানিয়াহুর সরকারকে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা তাদের নেশা। আর এখন গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে বিশ্বের মানবতাবাদীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও। ঠিক একই কারণে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে এদেশের তরুণ-যুবারা।

আমি লক্ষ্য করেছি সচেতন মানুষ পণ্য কেনার সময় জিজ্ঞেস করে কোন দেশের এটি। ভারতের শুনলেই বলে না, থাক। কেন ভাই, থাকবে কেন? গত মাসেও তো ওদের প্রোডাক্টই কিনেছেন। এখন আবার কী হলো। উত্তরে ক্রেতা বলেন, তখন অতটা সজাগ ছিলাম না। জানতাম ভারত বন্ধু রাষ্ট্র নয়, কিন্তু আমাদের ঘাটতি আছে বলেই তো সরকার বা ব্যবসায়ীরা ওই দেশের পণ্য আনে। এখন দেশের পণ্য কিনবো, দেখি আমরা কেমন উন্নতি করছি। কিংবা ভিন্ন দেশের পণ্য কিনবো। ভাই, পাকিস্তানি পণ্য দিই? ক্রেতা চোখ গরম করে বলে কেন এমন প্রস্তাব করলেন?

পাকিস্তানি পণ্য তো আমাদের দেশে আসেই না। কেনা, না কেনা তো পরের বিষয়। পেঁয়াজ কিন্তু পাকিস্তান, ভারত দু’দেশ থেকেই আসছে। পেঁয়াজের মান ও দাম যার কম ও ভালো হবে, সেই দেশের পেঁয়াজই কিনবো। তবে সব কিছুর আগে বাংলাদেশের পেঁয়াজই কিনবো। দুই টাকা দাম বেশি হলেও, কিনবো।

এই হলো নতুন চিন্তাধারা, নতুন করে নিজেদের প্রতি ভালোবাসার লক্ষণ। আমরা যদি সব রকম মসলা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতাম তাহলে কি ভারতীয়/পাকিস্তানি/মিয়ানমারের কৃষিপণ্য আমদানি করতে হতো? না, হতো না। আমাদের জনসংখ্যা জমির তুলনায় অনেক বেশি। কৃষিজমি প্রতিদিনই কমছে। এর কারণেই ইচ্ছা থাকলেও মসলা জাতীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সেই ঘাটতি মেকাবিলায়ই আমরা আমদানি করছি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন বিক্ষোভ ও সংঘাতের কারণে আরো গভীর হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, এরই জেরে আগস্টে ভারতের রপ্তানি কমেছে। মূলত বস্ত্র ও পোশাক পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমায় এ পতন হয়েছে। 

এই রিপোর্ট যে মিথ্যা সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া রেমিট্যান্স প্রবাহের তথ্যই প্রমাণ করে দিচ্ছে। তার মানে ওই প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক এবং হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের পর বিভিন্ন বিক্ষোভ এবং সংঘাতের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট বেড়েছে, যার জেরে ভারতের রপ্তানি ২৮ শতাংশ কমে গেছে বাংলাদেশে। আসলে ভারতীয় পণ্য না কেনার মানসিকতাই এজন্য দায়ী। ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আচরণ আমাদের গণমনে আঘাত করায় এই পরিণতি ঘটেছে।

দিন দিন ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হবে না, এই সত্য আমরা জানি। আর সেটি আমরা চাইও না। ধীরে ধীরে ওই রাষ্ট্রটির অপ্রতিবেশিসুলভ দাদাগিরির চাপ কমিয়ে আনবো আমরা। সুপ্রতিবেশী হতে হলে কেমনতর আচরণ ও বন্ধুত্ব দেখাতে হয় তা বিএসএফের মালিক মোদি সরকার বোঝে না। সীমান্ত হত্যাই কেবল বন্ধ করতে হবে না ভারতকে, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমস্যার সমাধানে আসতে হবে তাদের। মনে রাখতে হবে যে মণিপুর রাজ্যের রাজনৈতিক ও জাতিগত বিরোধের সূত্রে প্রজ্বলিত আগুন সেখানকার সাতটি রাজ্যেই তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। আর তিস্তা অববাহিকা নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি করা হযেছে, তাকে যত জিইয়ে রাখা হবে, ততই তা ঘনীভূত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনের মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে আশ্রয়ের পর তেমন কোনো রকম বিক্ষোভ হয়নি, যা হয়েছে আওয়ামী ও ভারতীয় এজেন্টদের উসকানিতে গার্মেন্ট সেক্টর অস্থিতিশীল করে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিতে ফেলে স্বৈরাচারকে পুনর্বাসনের চেষ্টা। সেটি হতে দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে আশুলিয়া ও গাজীপুরের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে পুরোদমে কাজ করছেন শ্রমিকরা। সময়টি এখন আন্দোলনের নয় এটি তারা বুঝতে পেরেছেন। শিল্প মালিকরাও বুঝেছেন। যারা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, এখনো হাসিনার দিবাস্বপ্নের অংশীদার হয়ে আছেন তাদের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হবে না।

একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন তারা যে দাতাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে এসেছে। দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণ তো আসছেই, তারপর এডিবির ১০০ কোটি ডলারের তহবিলসহ আরো উন্নয়ন সহযোগীরা আমাদের সংকট ও উন্নয়নের পথে বিনিয়োগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছে। আমরা যদি একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারি, ভিন্নমত ও পথকে আপাতত পরিত্যাগ ও পরিহার করে সামনে তাকাই, তাহলে অগ্রগতি কে থামাতে পারে?

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা নেতানিয়াহুর
ঢাকাসহ ১৩ অঞ্চলে ঝোড়ো হাওয়ার আভাস
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি শেরপুরে, মৃত্যু বেড়ে ৭
লেবাননে ৬ দিনে ৪৪০ হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত
বাংলার সৌরভ ট্যাংকারে অগ্নিকাণ্ডে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দুর্গাপূজায় সারাদেশে দুই লাখের বেশি আনসার মোতায়েন হচ্ছে
সাংবাদিক হিসেবে কারো বিরুদ্ধে মামলা হোক আমরা তা চাইনা: শ্যামল
পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী তৎপর থাকবে: সেনাপ্রধান
এক অভিনব প্রতিশোধ...
পূর্বধলায় বন্যার্তদের মাঝে সেনাবাহিনীর ত্রাণসামগ্রী বিতরণ
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft