শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আহমদ ছফার কালজয়ী সৃষ্টি মরণ বিলাস
এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪, ৩:৪৮ PM
মৃত্যুর দোরগোড়া অবধি না গিয়েও একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মনের অনুভূতি এত সাবলীল ও সূক্ষ্ম করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলা, নিজ মানস দিয়ে অপরের জীবন এত গভীরভাবে উপলব্ধি করা শুধু আহমদ ছফার দ্বারাই হয়তো সম্ভব।

‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার একটি রাজনৈতিক উপন্যাস বলা যায়। এই উপন্যাসটিতে যেভাবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুশয্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বেশ সূক্ষ্ম; এবং তাতে বিসভিন্ন মতবাদ, ঘটনা এবং মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

এবং সেই চিত্রপটে মূল ভুমিকায় আছেন ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুমুখি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফজলে ইলাহি। আর, তাঁর শেষ শয্যায় বসে অথবা কখনো দাঁড়ায়ে আছে একজন পাতিনেতা ও রাষ্ট্রপতির সুদৃষ্টিতে আসতে ব্যাকুল মওলা বক্স। মরণ বিলাস উপন্যাসটি পুরোটাই মূলত মন্ত্রী ফজলে ইলাহি ও মওলা বক্সের মধ্যে কথোপকথন। 

শয্যাশায়ী মন্ত্রী চায় তার জীবনের যত গোপন অপকর্ম আছে তা অন্তত পৃথিবীর একজন মানুষকে বলে যেতে পারলে তার আর নিজের জীবনকে  বৃতা মনে হবে না। আর, মন্ত্রী চায় না তার এত গোপন অপকর্মের বোঝা সে একা বয়ে নিয়ে যাক পরপারে। তাই, মওলা বক্সকে বলে যেতে চায় তার সব গোপন পৈশাচিক কর্মকাণ্ড। তাদের কথোপকথনে, তর্কে-বিতর্কে, পারস্পরিক স্তুতি ও নিন্দায়, কখনো স্বগতোক্তিতে, কখনো সুস্পষ্ট উচ্চারণে, কখনো শালীন বাক্যে, কখনো খিস্তিতে, কখনো তীব্র ঘৃণায়, কিংবা কখনো বিনম্র শ্রদ্ধার অনুভূতিতে পেরিয়ে যায় হাসপাতালের শেষ রাতটি। আসে নতুন ভোর। কিন্তু সেই ভোরটি অবশ্যই অন্যরকম হয়। কাহিনীর মূল নায়ক ফজলে ইলাহী একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। 

তিনি দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ক্ষমতা এখনও বজায় আছে, ধড়ে এখনো জীবন আছে। কিন্তু কঠিন রোগের কারণে তার ভঙ্গুর জীবনের অনিশ্চয়তা তাকে সময়ের আগেই রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। একজন মহাক্ষমতাবান মন্ত্রী মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, কিন্তু তার শয্যার পাশে একজন পেশাদার স্বার্থান্বেষী সেবক ব্যতীত কেউ নেই- সহকর্মী, তোষামোদকারী, নেতা, এমনকি পরিবার-পরিজন কেউ না। ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারানো মন্ত্রীসাহেব যখনই সম্বিৎ ফিরে পান, তখনই তার মস্তিষ্কের অলিগলি ছাপিয়ে তার অতীত জীবনের সব স্মৃতি ভিড় করে আসে তার চোখের সামনে। 

সেসব স্মৃতি মূলত অসৎ কর্মের, পাপের স্মৃতি। তার যেসব পাপবোধ তাকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি, কিংবা স্পর্শ করলেও গ্রাস করতে পারেনি। তার দুরবস্থা টের পেয়ে যখন সেবক মাওলা বক্স তাকে তওবা করানোর জন্য মাওলানা ডাকার অনুমতি চায়, তখনই ধমক খেয়ে তাকে থেমে যেতে হয়- ‘মাওলা বক্স তুমি একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা, মৃত্যুর সময় মাওলানা ডেকে আমাকে দুর্বল করে ফেলতে চাও! সেটি হচ্ছে না মাওলা বক্স, সেটি হচ্ছে না।’ সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও তার কোনো ইচ্ছে দেখা যায় না। পাপ স্বীকার করার চাইতে বড় কঠিন কাজ তার জন্য ছিল পাপকে পাপ বলে গ্রহণ করা। যে পাপবোধের মুখ চেপে ধরে তিনি অন্তরের অন্দরে দাফন করে রেখেছিলেন সারাটি জীবন, জীবনের শেষ মুহূর্তে সেই পাপবোধ নিজের কফিন ভেঙে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বীকারোক্তির চেয়ে তাই আত্মোপলব্ধি তার জন্য বেশি জরুরি।

জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফজলে ইলাহী চান একজন শ্রোতা, যে কোনো বাধা না দিয়ে শুধু তার কৃতকর্মের ফিরিস্তি শুনে যাবে। দুঃসহ চেতনার ভারে, আর মৃত্যুর পরের অজানা জীবনের অনিশ্চয়তায় পড়েই হয়তো দিশেহারা হয়ে ওঠেন মন্ত্রী ফজলে ইলাহী। তার সৎ ভাইকে হিংসার বসে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছিল। তারপর এক সময় সে রেঙ্গুন প্রবাসী তার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে জরিয়ে পড়েছিল গভীর প্রণয়ে আর তার সাথে দীর্ঘকাল শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল সেই নারী। এরপর স্কুল জীবনে পড়াকালীন সময়ে অসৎ সঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে পরেন নানা অপকর্মে। ঘৃণার আগুনে জ্বালিয়েছে তার স্কুলের হিন্দু হেডমাস্টারের বসতবাড়ি; দগ্ধ করেছে তার হেডমাস্টার ও তার সব সহায়সম্বল। কীভাবে রাজনীতির সাথে জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে পরবর্তীতে সাধু নেতা সাজে। কীভাবে তার রাজনৈতিক সফলতা পায় সব ভয়ানক ঘৃণ্য পৈশাচিক কাজের পরও। 

আর তার কোন অপকর্মের জন্য সেই অনুতপ্ত নয়! বরং দুষে যায় তার জীবনের প্রেক্ষাপটকে,সমাজ পারিপার্শ্বিকতা সে আরো বলে, সে যে শুধু খারাপ কাজই করেছে তা না, তার জীবনে সে একটা মহৎ কাজ করেছে; আর তা হল একজন কিশোরের জীবন ভিক্ষা দিয়েছে সে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় একজন কিশোরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচিয়েছে সে। আর তার সেই মহৎ কাজ তাকে বার বার তার পাপবোধে গ্রাস হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে। যখন মৃত্যুশয্যায় তার জীবনের সকল অপকর্মের পাপবধ তাকে বাজেয়াপ্ত করতে চায় তখন সেই কিশোর এসে বাঁচায় তাকে। কিন্তু, তার অপকর্মের কথা শুনে; মওলা বক্স নিজের মধ্যে যুদ্ধ করছিল। ভাবছিল তার সাথেই কেন এসব হল? কেন তাকেই এইসব শুনতে হল। সে ভাবতে পারছিল না মন্ত্রী মারা যাবার পর তার জীবনে কি হবে।সে নিজেও অনেকখানি মন্ত্রির মতো চিন্তা রাখা সত্ত্বেও মেনে নিতে পারছিল না ‘মানব সন্তানের রূপে, এই রাক্ষস বৃত্তান্ত!’ তারপর মন্ত্রীর শেষ নিঃশ্বাসের আগে মন্ত্রী যখন তাকে বলল একটা আলো এসে গ্রাস করছে তাকে; আর তারপরেই নিথড় মন্ত্রীর দেহ। 

স্বর্গ আর নরকের চিরন্তন সহাবস্থানে মানবজীবন, ‘মরণ বিলাসে’র  মুখ্য উপজীব্য । ফজলে ইলাহী মূলত তার জীবনের তিনটি বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেন মাওলা বক্সের কাছে। কাম, লালসা, ঘৃণা আর অবিবেচনার মোড়কে আবৃত এই ঘটনাগুলো যেন মানব জীবনের চিরন্তন কদর্যতারই প্রতীক। প্রতিটি পাপকেই ফজলে ইলাহী পাশ কাটিয়ে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জীবনে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তার সকল অর্জনের নিষ্ফলতা তার সামনে প্রকট। আহমদ ছফা অতি সন্তর্পণে কথোপকথনের ছলে কাহিনী প্রবাহ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পাঠককে বিচারকের আসনে বসাতে চাননি। ফজলে ইলাহীর উক্তির মাধ্যমে তাই তিনি পাঠককে যেন একপ্রকার সাবধানই করে দিয়েছেন- ‘উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, শুনে রাখো, মানুষ মানুষের কর্মের বিচারক হতে পারে না। তারপরেও তোমার মন যদি কৈফিয়ত দাবি করে বসে, অবশ্যই আমারও কিছু বলার থাকবে।’ লেখক  পাঠককে তার কাহিনীর ও কাহিনীর ভেতরের কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি পাঠককে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ভাবতে উৎসাহিত করেছেন, একইসাথে অন্ধভাবে বিচার করতে বাধা দিয়েছেন। মূল তিনটি গল্পের বা ঘটনার বাইরে আরও একটি ঘটনা ছিল ফজলে ইলাহীর জীবনে, যা তাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপবোধের মধ্যেও মুক্তির আলো দেখায়। পাহাড় সমান পাপ করার পরেও কি একজন মানুষের পাপমুক্তির স্বপ্ন দেখা উচিত? ছফা ফজলে ইলাহীর ভাষায় বলেছেনÑ ‘ওহে মাওলা বক্স, তোমার সমস্ত হিসেব মুদি দোকানদারের মতো। তুমি যে অতো মানুষ হওয়ার গৌরব করছো, নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তুমিও কি মানুষ। মানুষের উচ্চতা, মানুষের গভীরতার কি জানো তুমি?’

মরণ বিলাস’র ছফা প্রচণ্ড আশাবাদী। মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে তার দৃপ্ত আশাবাদই মূলত ব্যক্ত হয়েছে এই বইটিতে। তিনি মানুষের প্রগতিতে ও চিরন্তন সম্ভাবনায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। যে ফজলে ইলাহী মাওলা বক্সকে কাহিনীর শুরুর দিকে বলেন, ‘মাওলা বক্স তুমি চাটুকার। তোমাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। তবু আমি তোমার তারিফ করি। তুমি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বলে ফেলতে পারো। এটি তুচ্ছ জিনিস নয়।’

তার মুখেই শেষের দিকে আমরা শুনতে পাই, ‘মাওলা বক্স তুমি নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীন মানুষ। তোমার নিষ্ঠুরতার সাথে দুনিয়ার কোনো একনায়কের নিষ্ঠুরতার তুলনা হয় না। তুমি এমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে যুক্তিজাল বিন্যাস করছো যা আমাকে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর করে তুলেছে। তুমি আমার আমিত্বকে খন্ড খন্ড করে কেটে ফেলছো।’

একজন পাপিষ্ঠ মন্ত্রী নিজের পাপ রোমন্থনের ছলে যেন তার বহুকষ্টে লভিত জীবনবোধ তার সেবকের ভেতরে ছড়িয়ে দিলেন। মন্ত্রী ও সেবক দুজনের জন্যই সে রাত শেষের ভোরটি অন্যরকম ভোর ছিল। একইসাথে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপ্রদতা, প্রভূত রিপু ও মানবীয় সীমাবদ্ধতাসমূহ অবজ্ঞা করে মানুষ হিসেবে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা, তাকে জড়িয়ে ধরার আহবান জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর একটি। আহমদ ছফা তার সূক্ষ্ম জীবনবোধ ও মানব দর্শন প্রকাশ করেছেন ‘মরণ বিলাস’-এ।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
ঢাকা ওয়াসার এমডি হলেন ফজলুর রহমান
১ অক্টোবর থেকে বিমানবন্দর এলাকা হর্নমুক্ত ঘোষণা
বিএসএমএমইউ শিক্ষক নিপুণ গ্রেপ্তার
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গ্রেপ্তার
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগে শরিক হতে প্রস্তুত বিশ্বব্যাংক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দিল্লিতে মেয়ের সঙ্গে থাকছেন শেখ হাসিনা, ঘুরতে দেখা গেছে লোদি গার্ডেনে
যুবককে পিটিয়ে হত্যা: ঢাবির ৫ শিক্ষার্থী আটক
ঢাবির হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনি, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির মৃত্যু
সেনাবাহিনীকে সব জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া ঠিক হবে না: ফখরুল
আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৬ জনের মৃত্যু: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft