‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম/গন্ধভরা ঘাস/ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ কবিতাকে যারা মূলত কবিতা লিখেন সেই কবিরা নানাভাবেই দ্যাখেন বা সংজ্ঞায়িত করেন। তবে কবি আল মাহমুদ কবিতাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন সেভাবে আর কেউ কোনোদিন করেননি। এত চমৎকার বিশ্লেষণ বা কবিতার সাথে উপমার তুলনা সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই। কবি আল মাহমুদ একজন খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন। যার কবিতার গ্রাম ও মাটির গন্ধ লেগে থাকত। যার কবিতায় প্রান্তিক মানুষ উঠে এসেছে। আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামীণ চিত্রই প্রস্ফুটিত হয় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। গ্রামের প্রকৃতি, নারী ও নদী চিত্রায়িত হয়েছে কবিতার শব্দের বুননে। জানা যায়, কবির প্রিয় কবি আরেক পল্লী কবি জসীম উদ্দীন। সে ধারায় তিনি খানিকটা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কখনো এসেছে সুক্ষ প্রতিবাদ, আবার কখনো এসে প্রেম। আবার কবি তার ‘অবুঝের সমীকরণ’ কবিতায় লিখেছেন, কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর/ দেশের অগণ্য চাষি, চাপরাশী/ ডাক্তার উকিল মোক্তার/পুলিশ, দারোগ ছাত্র অধ্যাপক সব/ কাব্যের ব্যাপারে নীরব! এই হলো কবি আল মাহমুদ। যার চিন্তা-ভাবনা ছিল কবিতা নিয়ে। সোনালী কাবিনের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে আল মাহমুদকে বিবেচনা করা হয়। কবি আল মাহমুদের পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মৌড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব এবং মা রওশন আরা মীর। ৫০-এর দশকে তিনি ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা লেখার জন্য যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। সে হিসেবে পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ। ওই দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তখন ১৯৫৪ সাল। তাকে পাঠকদের সাথে কবি হিসেবে গুরুত্ববহ করে তোলে তার লোক লোকান্তর কাব্যগ্রন্থটি। যদিও এর আগে থেকেই তিনি এপার ও ওপার বাংলায় বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। উপন্যাস বের হয় তারও অনেকটা পরে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস আসে কবি ও কোলাহল। তিনি মহান ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর কবিতা লিখে গণসচেতনতা তৈরি করেছেন। কলমের দ্বারা তিনি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কখনো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো প্রুফ রিডার ছিলেন, কখনো কবিতা লিখে গেছেন নিরন্তর। একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশু-সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি বাংলা কবিতায় সৃষ্টি করেছেন এক ভিন্নমাত্রা। একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণে। ১৯৩০-এর কবিদের হাতে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার ঊন্মেষ, তার সাফল্যের ঝাণ্ডা আল মাহমুদ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে অদ্যাবধি তুলনারহিত কৃতিত্বের সঙ্গে বহন করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীনদেশে ফিরে তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকাত সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ সময় তিনি শিল্পকলা একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোচিত কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন। সোনালী কাবিন হলো কবির শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মৌলিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এমনকি তার সমালোচকরা এ নিয়ে দ্বিমত করেন না। আল মাহমুদ প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।
তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর লিখলেন, ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/বরকতের রক্ত/হাজার যুগের সূর্যতাপে/ জ্বলবে এমন লাল যে,/সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে! আবার ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদের মৃত্যু নিয়ে লিখলেন, ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/দুয়োর বেঁধে রাখ।/কেন বাঁধবো দোর জানালা/তুলবো কেন খিল?/আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ফিরবে সে মিছিল।/ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/মতিয়ুরকে ডাক।/কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!/তোরাই তবে সোনামানিক/আগুন জ্বেলে দে। কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাব্য সম্ভার লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৭), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫), আরব্য রজনীর রাজ হাঁস (১৯৮৭), প্রহরান্তের পাশ ফেরা (১৯৮৮), একচক্ষু হরিণ (১৯৮৯), মিথ্যাবাদী রাখাল (১৯৯৩), উড়ালকাব্য (২০০৩) প্রভৃতি। তার গল্পগ্রন্থ যার সঙ্গে পরিচয় হয়Ñ পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫), সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮৩), গন্ধ বণিক (১৯৮৮), ময়ূরীর মুখ (১৯৯৪), নদীর সতীন (২০০৪) ইত্যাদি। তার উপন্যাসসমূহের মধ্যে ডাহুকী (১৯৯২), কাবিলের বোন (১৯৯৩), নিমিন্দানারী (১৯৯৫), আগুনের মেয়ে (১৯৯৫), উপমহাদেশ (১৯৯৩), কবি ও কোলাহল (১৯৯৩), চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবির সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন বহু পুরস্কার।
আজকালের খবর/আরইউ