
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় তেজ আছে। বিপ্লব বিপ্লব টাইপের তেজ। যেন মাংস কসানোর আগে তেলে ভাজা হচ্ছে পেঁয়াজ রসুন, হঠাৎ জল পড়ল কয়েক ফোঁটা, হঠাৎই ছ্যাঁত করে উঠল। ওই মুহূর্তে আমার ভেতরকার জিজ্ঞাসা আর ভালো লাগা বলকে উঠে। রসনার রসিকতা এখানে, রসনার ভাষাও যে আছে সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা পড়লে বুঝতে পারি। সহজাত বিষয়-আশ সহজে বলে দিতে পারেন সাজ্জাদ বিপ্লব। যেন আপনারই আকুতি; আপনি এসব কবিতা পড়ে বিপ্লবী হবেন কিনা নিজের ব্যাপার তবে বিপ্লবের সৌন্দর্য সাধনে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সিদ্ধহস্ত কবি সাজ্জাদ বিপ্লব...
একটা কথা বলি, একজন কবি নিজের জন্য লেখেন। বিপ্লব ঘটান নিজের মধ্যে। এই বিপ্লব কারও মাঝে ছড়িয়ে পড়লে সেটি বাড়তি আনন্দ। কেন নয়- রন্ধনশিল্পী তো প্রথমে নিজের জন্যই রাঁধেন; সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা এখানেই ভালো লাগার যে- নিজের বোধের কৌমার্যে সমাসীন ভাবের চাদরে, সেখানে ক্ষোভ নেই আক্ষেপও নেই, উদযাপন আছে চমৎকার...সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘আমার হাঁসগুলো কবিতা পাড়ে’ বইটির নাম শুনেই চমকিত হয়ে যাবে অনেকে কিন্তু আমার চমকে যাওয়ার অভ্যেস নেই; কেননা আমি মনে করি সাজ্জাদ বিপ্লব লিখবেন সাজ্জাদ বিপ্লবের মতো, মাহমুদ নোমান লিখবেন মাহমুদ নোমানের মতোই; আমি প্রস্তুত হয়েই একজন কবির কবিতা পড়তে যাই...
২.
স্বভাবতই কবি যে চিন্তাধারায় কবিতা লেখে আর পাঠক সেটি ভাববে এমনও নয় তবে ‘আমার হাঁসগুলো কবিতা পাড়ে’ বইটির কবিতাগুলো সাজ্জাদ বিপ্লব একেকজন কবিকে স্মরণে লিখেছেন; বলতে পারেন একজন কবি আরেকজন কবির বোধ বিশ্বাস নিয়ে নিজস্ব খেয়ালে বৈপ্লবিক উচ্চারণ করেছেন। প্রথম দিকে মনে হতে পারে সাজ্জাদ বিপ্লব লোক দেখানো ইসলামিক চিন্তাধারার সাহসী কণ্ঠস্বর; আবার তিনিই তুলে ধরেন তসলিমা নাসরিনের ভাব তত্ত্ব নিয়ে কবিতা, শামসুর রহমানকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন মমত্ববোধে; কয়েকজন তরুণ উৎসাহে আল মাহমুদ নিয়ে মেতেছে এই চিত্রিতে ভাবকল্পে কবিতা, হাংরি জেনারেশন নিয়ে যে বিপ্লবী মলয় রায়চৌধুরী কিংবা আব্দুল মান্নান সৈয়দ নিয়ে কবিতাগুলো পাঠককে আন্দোলিত করবে। কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, জিজ্ঞাসা-কল্পনা নিজের চাওয়া সব একীভূত করার প্রয়াস। সাজ্জাদ বিপ্লব বিনয় মজুমদার ও জীবনানন্দ দাশকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন এই বইটিতে; তাহলে কী ভেবে নিব হাঁসগুলি মূলত সাজ্জাদ বিপ্লবের মনে আলোড়িত একেকজনের কবিসত্তা? কবি তার ভাবনা ভাবতে পারেন, কয়েকজন কবি হাঁস হয়েছে উপমায় সেটিও মানলাম তবে কীভাবে কবিতা পাড়ে সেটি যথেষ্ট ভাবনায় দোলায়...
মূলত সাজ্জাদ বিপ্লব আধ্যাত্মিক সরলতার কবি। বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আড়ালে তাকালেই সৌন্দর্যের যত আড়াল উন্মোচিত হয় মাশুকের জ্ঞানে; আমি সচরাচর বলি কবি বলতে আধ্যাত্মিকতার চাষা। কবিকে ধরতে পারার সাধ্য আছে কার সাধন বিনে আর অসীম ভেদে ওইসব স্তরে পৌঁছে লেখা হয় একেকটি অমর কবিতা। কবিতা মূলত বাইতেনে জ্ঞানের জাহেরি প্রদর্শন। প্রদর্শনের স্কিল জরুরি হয়ে পড়ে। এখানেই অনেক কবি আলাদা হয়ে পড়ে। ‘আমার হাঁসগুলো কবিতা পাড়ে’ বইটির প্রথম কবিতাটি পড়া যাক-
সিক্রেট বা গোপনীয় বলেই/তুমি সুন্দর। অপরূপ।/তোমার রূপের বর্ণনা করি এ সাধ্য কই? কই সে যোগ্যতা? ক্ষমতা বা অক্ষমতা?/অসারতাও বলতে পারো, সব-ই তোমার জন্য, তোমার নামে।/যে নামে এই ধরাতে, সমধারায় প্রেম নামে, কাম নামে। নামে প্রকৃতি ও বৃষ্টির সম্ভার।/আহা! কী যে অপরূপ রূপের বাহার, গো তোমার!! (তুমি)
গোপনীয়তার পর্দায় বিম্বিত সত্যের মধ্য দিয়ে ‘আমার হাঁসগুলো কবিতা পাড়ে’ বইটির সূচনা, অর্থাৎ বিধাতার অস্তিত্বকে উপলব্ধ, এই যে বাইতেনে উপলব্ধি গাম্ভীর্যে চরম ভক্তি-প্রেম বিশ্বাসে; এরপরে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সাজ্জাদ বিপ্লবের ভক্তি, এরপরই আস্তে আস্তে খোলাসা করে করে এগিয়েছেন উনার প্রিয় একেকজন কবিকে নিয়ে ভাবকল্পনা; এরমধ্যে ‘রাইসু ও শাহরিয়ার’ কবিতাটি পড়ে আনন্দ পেয়েছি, আলাদা টাচ্ ছিল-
‘রাইসু’র চোখে শাহরিয়ার এক মজার কবিতা/একজন আরেক জন রে খিস্তি করার দায়ে ঝুলায়া রাখে/আরেক জন ঝুল বারান্দা থাইকা নিজেই লাফ দেয় ভাষার সমুদ্রে/কয়, খালি গায়ে একলা গোছল করুম ক্যা/রবী ঠাকুর, আল মা'মুদ এগোরেও নামাই ভিজাই/একটু-আট্টু মশকরা করি (রাইসু ও শাহরিয়ার)
৩.
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা আপনার মাথাব্যথার কারণ হবে না। মনে প্রশান্তি আনার সারল্যে ডুবসাঁতরে পার হবেন সহজাত আন্তরিক ভাষায় বলনে আর চলনে; বয়ানে মুন্সিয়ানা না- বলে বলবো সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার টিউনিং সহজে মরমে পৌঁছে যাওয়া উচিত উপমার নাদুস-নুদুস চিত্রকল্পে, কয়েকটি কবিতা পড়ে উপরোক্ত কথাসব আওড়াতে পারেন আপনিও-
মাঝে-মাঝে বিনয় মজুমদার/মন্দ না/বিনয় আর অনেক-অনেক মজুমদার (বিনয় মজুমদার)
খ.
বলো, এর চেয়ে হাস্যকর ও আয়রনি আর কী হতে পারে!/তসলিমা নাসরিনের মুখে বা ভাষায় যদি ইসলামের রিফর্মেশনের জন্য দরদ একেবারে উথলে ওঠে/যেন বলক ওঠা দুগ্ধ বা ফেন/উপচে পরতে চাইছে রাইসকুকার ঠেলে/তুমি হয়তো, বলবে, এতে তসলিমার দোষ কোথায়? সে তো প্রভুদের হাতের, ইচ্ছার, ক্রীড়নক মাত্র। (তসলিমা নাসরিন)
গ.
আমি জীবনানন্দ দাশ রে/দেখি নাই।/আমার বাপ রে দেখছি।/আমার বাজান কবিতা লেখে নাই।/আমি যে কবিতা লেখছি!/কিন্তুক আমি জীবনানন্দ’র মাঝে/আমার বাপেরে খুঁইজা পাই।/যদিও আমার বাপের মধ্যে/আমি জীবনানন্দ দেখি নাই।/তার মানে, আমার মধ্যে আমার বাজান আছে।/তার মানে আমার ভিতর বাজানের মতো দেখতে জীবনানন্দ আছে।/তার মানে জীবনানন্দ'র মতো একজন কবি আছে।’/তার মানে আমি... (আমি অথবা জীবনানন্দ)
প্রতিটি সিনেমা দেখাশেষে দর্শকের অনেক ভাবনা মনে ওঁত পেতে থাকে। সেসব সিনেমার দৃশ্যে কলাকুশলীদের সঙ্গে সমাধা করার সুযোগ পেলে অন্য রকম কিছু হতো। ‘আমার হাঁসগুলি কবিতা পাড়ে’ বইটিও তেমন প্রিয় কবিদের পাঠশেষে কবিতার টেবিলে- দৃশ্যায়নে কবিকে নিয়ে পাঠ আলোচনা, কত কত জিজ্ঞাসা; সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা আপনাকেও তেজোদ্দীপ্ত করবে সুনিশ্চিত...
আজকালের খবর/আরইউ