শনিবার ৬ জুলাই ২০২৪
এক ছাগলে উন্মোচিত অনেকের মুখোশ
প্রভাষ আমিন
প্রকাশ: সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ৭:৫৬ PM আপডেট: ০১.০৭.২০২৪ ৮:৫২ PM
কথায় বলে ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।’ ছাগলের প্রিয় খাবার কাঁঠাল পাতা, সে আমরা জানি। তবে ছাগল আসলে সর্বভুক। সবকিছুতেই মুখ দেয়। কিন্তু একটা কতকিছু খেতে পারে, তার প্রমাণ এখন দেশবাসীর সামনে। নিরীহ একটা ছাগল উন্মোচিত করে দিয়েছে অনেক ছাগলের মুখোশ। বাংলাদেশে দুর্নীতি, প্রতারণা, দেখনদারির বহুমাত্রিক স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এক ছাগলকাণ্ডে। পবিত্র ঈদুল আজহায় যে ছাগলের কোরবানি হওয়ার কথা ছিল, সেই ছাগল এখনও বহাল তবিয়তেই আছে; তবে কোরবানি হয়ে গেছেন আরো অনেকে।

প্রথম কথা হলো, কোরবানি করা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহর জন্য নিজের প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করা। এখানে দেখনদারীর কোনো ব্যাপার নেই। আপনি আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন, এখানে পশু বড় না ছোট, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। এক গরুতে সাতজন পর্যন্ত কোরবানি দিতে পারেন। এখন কেউ বলতে পারেন, যার সামর্থ্য আছে, তিনি তো চাইলে দামি পশু কোরবানি দিতে পারবেন। অবশ্যই পারবেন। কিন্তু আসল কথা হলো, দামি পশু কেনার টাকাটা তো সৎ পথে উপার্জিত হতে হবে।

সবাইকে প্রশ্ন করতে হবে। দায় নিতে হবে সবাইকেই। মতিউরের দুর্নীতির সাজা পেতে হবে তার স্ত্রী, সন্তানদেরও। একজন সরকারি চাকুরে যদি তার সন্তানকে চারটি গাড়ি কিনে দেন, তাহলে প্রশ্ন না করার দায় নিতে হবে সন্তানকেও। বারবার প্রশ্ন করেই দুর্নীতিবাজকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতিবাজকে সম্মান না করে ঘৃণা করতে হবে।

এই কলামে লিখেছিলাম ‘চুরি করা গরুতে কোরবানি হয় না’। ব্যাপারটা এমনও নয় আপনি বেতনের টাকায় কোরবানি দিলেন, আর ঘুসের টাকায় আয়েশ করলেন। এক মণ দুধ নষ্ট করার জন্য যেমন এক ফোঁটা চনাই যথেষ্ট, তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত এক টাকা আপনার কোটি টাকাকেও নষ্ট করে দেবে। তাই একজন দুর্নীতিবাজের কোরবানি কখনোই কবুল হবে না।

দুর্নীতিবাজ পিতা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত কোরবানির নামে স্যাক্রিফাইসের বদলে দেখনদারি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। ১৫ লাখ টাকা দিয়ে আপনি ছাগল কিনতেই পারেন, কিন্তু আপনার সরকারি চাকুরে বাবার বেতনের সাথে কি ১৫ লাখ টাকার ছাগল যায়? এখন জানা যাচ্ছে, ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিয়ে আলোচনায় এলেও ইফাত প্রতি বছরই ৬০-৭০ লাখ টাকার পশু কোরবানি দেন। কোরবানি তার কাছে ইবাদত নয়, নেশা। এখন এই ছাগলকাণ্ডে ইফাত নিজেই কোরবানি হয়ে গেছেন। যার টাকায় কোরবানির নামে ফুটানি করতেন, সেই বাবাই তাকে অস্বীকার করেছেন। ইফাত রীতিমতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। পত্রিকার খবর মাকে নিয়ে তিনি পালিয়েছেন।

এতদিন জানতাম কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়, এবার দেখলাম ছাগল খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছে বাপ। ইফাতের পিতা মতিউর রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বড় কর্তা ছিলেন। তিনি ইফাতকে সন্তান হিসেবে অস্বীকার করলেও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। প্রথম স্ত্রীর সন্তান না দ্বিতীয় স্ত্রীর, সেটাও বিষয় নয়। ছাগল, কোরবানি ছাপিয়ে এখন সামনে এসেছে মতিউর রহমানের অঢেল অর্থসম্পদের খবর। এরই মধ্যে তিনি রাজস্ব বোর্ড থেকে বদলি হয়েছেন, সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। এতকিছু হারিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি রীতিমতো লাপাত্তা হয়ে গেছেন।

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, মতিউর রহমান মাথা কামিয়ে বেশভূষা বদলে গোপনে দেশ ছেড়েছেন। আহা ছাগলকাণ্ডে প্রথম কোরবানি তার সম্ভাব্য ক্রেতা ইফাত, তারপর ইফাতের পিতা মতিউর রহমান। এখন প্রতিদিনই মতিউর রহমানের নতুন নতুন সম্পদের বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে।

বেচারা মতিউর রহমানের জন্য আমার মায়াই লাগছে। তিনি যে এত টাকা চুরি করলেন, কাদের জন্য। নিশ্চয়ই স্ত্রী-সন্তানের জন্য। কিন্তু এখন সেই সম্পদ তার গলার কাঁটা হয়ে গেছে। ঠেলায় পড়ে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে হচ্ছে। প্রথম পক্ষের কন্যা ইপ্সিতা, যিনি বাপের টাকায় কানাডায় আট কোটি টাকার বাড়িতে থাকেন আর চার কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকান; সেই কন্যাও এখন বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

তিনি নাকি তার বাপকে কখনো ক্ষমা করবেন না। যার জন্য চুরি করে, সেই বলে চোর। মতিউর রহমানের অবস্থা দেখে আমার নিজাম ডাকাতের কথা মনে পড়ে গেলো। একবার এক দরবেশ কুখ্যাত নিজাম ডাকাতকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত চুরি-ডাকাতি কাদের জন্য করো। নিজাম ডাকাত বললেন, স্ত্রী-সন্তানের জন্য। দরবেশ বললেন, তারা কি তোমার পাপের ভাগ নেবে।

নিজাম ডাকাত বললেন, অবশ্যই নেবে। দরবেশ বললেন, বাড়ি গিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে জিজ্ঞাসা করে দেখো। বাড়ি গিয়ে নিজাম ডাকাত স্ত্রী-সন্তানকে ডেকে জানতে চাইলেন, আমি যে তোমাদের জন্য এত কিছু করি, তোমরা আমার পাপের ভাগ নেবে তো। জবাবে স্ত্রী-সন্তান বললো, তোমার দায়িত্ব আমাদের ভরণপোষণ দেওয়া। তুমি যা দেবে, আমরা তাই খাবো। তুমি কোত্থেকে আনবে, সেটা তোমার ব্যাপার।

স্ত্রী-সন্তানের কথা শুনে চোখ খুলে নিজাম ডাকাতের। তিনি সেই দরবেশের কাছে গিয়ে নিজের সব পাপ কাজ ছেড়ে দিলেন এবং নিজেও দরবেশ বনে গেলেন। নিজাম ডাকাত হয়ে গেলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। মতিউর রহমানের দিব্য চোখ খুলবে কি না, তিনি মতি চোরা থেকে মতি আউলিয়া বনে যাবেন কি না; সেটা জানার আপাতত কোনো উপায় নেই। কারণ ছাগলের মতো ছাগলের বাপেরও কোনো খোঁজ নেই। এটা খুব ইন্টারেস্টিং। সারাজীবন চুরি করে টাকা কামিয়ে এখন মতিউর রহমানের উপাধি হলো ছাগলের বাপ। এখন সবাই বলে ছাগল, ছাগলের বাপ, ছাগলের সৎমা, ছাগলের মা, ছাগলের বোন। হায়রে হাজার কোটি টাকার বাগান খাইলো লাখ টাকার ছাগলে।

মূল ছাগল কোরবানি না হলেও ছাগলের সম্ভাব্য ক্রেতা, ক্রেতার বাপ ও চৌদ্দগোষ্ঠী কোরবানি তো হলোই; বাদ পড়লো না বিক্রেতা সাদিক অ্যাগ্রোও। কোটি টাকার গরু আর ১৫ লাখ টাকার ছাগল দিয়ে আলোচনায় আসা সাদিক অ্যাগ্রো পুরোটাই সরকারি জায়গা দখল করে বানানো হয়েছিল। এখন সেটা উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তার মানে এই ছাগল আলোচনায় না এলে মতিউর রহমানও চুরি চালিয়ে যেতে পারতেন। সাদিক অ্যাগ্রোও সরকারের জায়গা দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতো।

তবে সাদিক অ্যাগ্রোর অপরাধ শুধু সরকারি জমির দখল করাই নয়। বহুল আলোচিত ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিয়ে রীতিমতো প্রতারণা করেছে। বলা হচ্ছিল এটি ব্রিটল প্রজাতির উচ্চবংশীয় ছাগল। এখন জানা যাচ্ছে, যশোর থেকে মাত্র একলাখ টাকায় ছাগলটি কিনে এনে ১৫ লাখ টাকা দাম হাঁকিয়েছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ছাগলটি অবিক্রীত রয়ে গেছে। ছাগলটি প্রাণে বেঁচে গেলেও উন্মোচিত করে দিয়েছে আরো অনেক ছাগলের মুখোশ।

লেখাটি শেষ করছি, নিজাম ডাকাতের গল্পের কাউন্টার ন্যারেটিভ দিয়ে। সংসারের কর্তা যেখান থেকে ইচ্ছা টাকা এনে স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণ করবেন, এই ধারণা বদলানোর সময় চলে এসেছে। প্রথম কথা হলো, পুরুষই যে সবসময় সংসারের কর্তা হবেন, সেই ভাবনাও আর নেই। এখন অনেক কর্মজীবী নারীও সংসারের অনেক দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া বিনা প্রশ্নে সংসারের কর্তার অর্থ ব্যয় করবেন, স্ত্রী-সন্তানকে একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও হবে না। স্বামী বা পিতা কী চাকরি করেন, তার মাসিক আয় কত; এটাও সংসারের অন্য সদস্যদের জানতে হবে।

সন্তানকে প্রশ্ন করতে হবে, তুমি বেতন পাও ৫০ হাজার টাকা, বাসা ভাড়া দাও ৬০ হাজার টাকা। বাকি টাকা কোত্থেকে আসে। শুধু সংসারের লোক নয়, প্রশ্ন তুলতে হবে স্বজন প্রতিবেশীদেরও। আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকলে, সবাইকে প্রশ্ন করতে হবে। দায় নিতে হবে সবাইকেই। মতিউরের দুর্নীতির সাজা পেতে হবে তার স্ত্রী, সন্তানদেরও। একজন সরকারির চাকুরে যদি তার সন্তানকে চারটি গাড়ি কিনে দেন, তাহলে প্রশ্ন না করার দায় নিতে হবে সন্তানকেও। বারবার প্রশ্ন করেই দুর্নীতিবাজকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতিবাজকে সম্মান না করে ঘৃণা করতে হবে।

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
হত্যা মামলা: বাঘা পৌরসভার মেয়র ঢাকায় গ্রেপ্তার
জনগণ দেশ পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে
নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
কোটা বাতিলের দাবিতে যবিপ্রবিতে বিক্ষোভ
ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ১০
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বড়াইগ্রামে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশিক হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই: এমপি সুমন
বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত
অনেক ঝড়ঝাপটা পার করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মেয়াদ বাড়ল আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনের
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft