বুধবার ৩ জুলাই ২০২৪
পুঁজিবাদ সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪, ৮:১৯ PM
ব্যাপারটা নতুন নয়, প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত পুরাতন বটে, প্রকৃতিকে জয় করতে হবেÑ এ প্রতিজ্ঞা নিয়েই সভ্যতা এগিয়েছে। প্রকৃতিকে মানুষ ব্যবহার করছে, নিজের কাজে লাগিয়েছে এবং ধ্বংসও করেছে। ফলটা দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ। সারাবিশ্বে প্রকৃতি আজ যতটা বিপন্ন, তেমনটা আগে কখনো ঘটেনি। কিন্তু বিপদ তো কেবল প্রকৃতির নয়; মানুষেরও। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটি ব্যাপার আছে। প্রকৃতি সেই প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ যতটা বিপন্ন, তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।

দারিদ্র্য তো ছিলই। তা দূর করার নানা রকম চেষ্টা চলেছে, এখনো চলছে। খুব যে ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নয়। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। তারা অপুষ্টিতে ভোগে, স্বাস্থ্যসেবা পায় না। তাদের জীবনে অভাব রয়েছে বাসস্থান, বস্ত্র ও শিক্ষার। কিন্তু যে ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি, তা এখন ঘটছে। বিশ্বজুড়ে সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্যের। পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তাও গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বিশ্ব আজ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক আলোকিত। সেই আলোর নিচে ভয়াবহ অন্ধকার ধরা পড়েছে।

এটি প্রায় অবিশ্বাস্য সংবাদ। বিশ্ব এত এগিয়েছে, এত রকমের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ঘটেছেÑ চাঁদে গিয়ে বসবাসের কথা ভাবা হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দরুন বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নত বিশ্ব ব্যাপক হারে মানুষ খুনেও দ্বিধা করছে না। এমনকি সেই আদিম বর্বরতার কালে খাদ্য সংগ্রহ নিয়ে যে দুর্ভাবনা মানুষকে কাতর করে রাখত, তা আবার দেখা দিয়েছে। কাকে বলব অগ্রগতির নিরিখ? বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিকে, নাকি আদিম খাদ্যাভাবের প্রাদুর্ভাবকে?

খাদ্যাভাবের সঙ্গে প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষরূপে জড়িত। লোকসংখ্যা বেড়েছে, ফসলের জমি বাড়েনি। কোথাও কোথাও উৎপাদনের জমি খালি পড়ে থাকে; অন্যত্র এর ভীষণ অভাব। জ্বালানি পুড়িয়ে আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও সংখ্যা বেড়েছে। প্রাণহানি ঘটছে মানুষের; নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল ও ফসলের মাঠ। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য সংকট।

বিজ্ঞানীরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই বলে এসেছেন, প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করতে নেই। করলে প্রকৃতি বিরূপ হবে, হয়তো প্রতিশোধ নেবে। বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক প্রবক্তা ডারউইনও ওই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন; কিন্তু মানুষ সেসব কথা শোনেনি। একদিকে প্রকৃতির বন্দনা গান করা হয়েছে; তাকে নিয়ে শিল্প-সাহিত্য তৈরি করা হয়েছে; অন্যদিকে প্রকৃতিকে পরিণত করা হয়েছে পণ্যে। এর যা কিছু আছে সবই লুণ্ঠন করা হয়েছে।

মানুষও আসলে প্রকৃতির অংশ। কিন্তু যতই সে উন্নত হয়েছে, ততই বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রকৃতি থেকে। ফলে একদিকে সে যেমন শিকার হয়েছে প্রকৃতির রুদ্ররোষের; অন্যদিকে নিজেও ভীষণ কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। তার স্বভাবে দেখা দিয়েছে নিষ্ঠুরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা।

পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জল, এক ভাগ স্থল- ভূগোলের বইয়ে এমনটিই পড়েছি। কিন্তু আজ পানীয় জলের ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে। পানি যে কেমনভাবে দূষিত হয়েছে, এর প্রমাণ আমাদের বুড়িগঙ্গা। এটি এখন পরিণত হয়েছে একটি বিষাক্ত নর্দমায়। অথচ ওই বুড়িগঙ্গাতেও লঞ্চডুবি হয়, মানুষ মারা যায়।

এই যে প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ বলছি, তারা কোন মানুষ? সব মানুষ এ কাজ করে না। মূল কাজটা ধনীদেরই। বলতে হবে পুঁজিবাদীদেরই। পুঁজিবাদী বিশ্বই মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ায়। তারাই পানিতে বর্জ্য ফেলে, জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটায়; অনিবার্য করে তোলে বহুবিধ মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। গরিবরা গরিব হয় ধনীদের কারণেই এবং গরিব অবস্থায় ধনীদের অনুকরণ করে।

চীন এক সময়ে সমাজতন্ত্রী ছিল। আজ আর নেই। নেই যে, তা বোঝা যাচ্ছে এর পুঁজিবাদী আচরণে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি সেও পোড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে একদা যে দেশ তাদের ভয়ংকর রকমের শত্রু ছিল, সেই আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে এবং রাজি হচ্ছে না জ্বালানি ব্যবহারের ব্যাপারে সংযত হতে। তাদের আচরণ অবিকল পুঁজিবাদের মহানায়ক আমেরিকার মতোই। চীন নিজের দেশের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশকে ইতোমধ্যে বিপন্ন করে তুলেছে। এখন ধরিত্রীকে তপ্ত করার ব্যাপারে হাত মিলিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে।

পুঁজিবাদী বিশ্বই মানুষের জীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে; আবার তারাই বিপর্যস্ত মানুষের জন্য সাহায্য করবে বলে নানা রকম আয়োজন চালায়। আমাদের দেশে প্রবাদ আছেÑ ‘গরু মেরে জুতা দান’, এ ব্যাপারটিও ওই রকমের। ওই যে বলা হয়Ñ ‘তুমি সাপ হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো’। সাহায্যদানের ঘটনা সেই ধরনেরও বটে। দংশন তারা করেছে, আবার প্রতিকার তারাই করবে বলছে। কিছুতেই স্বীকার করবে নাÑ বিপর্যয়ের জন্য তারাই দায়ী।

পুঁজিবাদীরা যুদ্ধ লাগায়। মারণাস্ত্রের আঘাতে মানুষ মারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে; লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে। অতীতের দুটি বড় বিশ্বযুদ্ধ তাদেরই কীর্তি। এখন প্রতিনিয়ত স্থানীয় যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে; বিবদমান উভয় পক্ষের কাছে নগদ অর্থে অস্ত্র বিক্রি করছে। এও তাদের হস্তক্ষেপের আরেক নৃশংস দৃষ্টান্ত বটে। উস্কানি দিয়েই থামেনি; ইউক্রেনকে মাঝখানে রেখে পুঁজিবাদী দুই পক্ষ যুদ্ধ বাধিয়েছে। জায়নবাদী ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে অবিরাম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, মানবতাবাদী দাবিদার সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে।

পুঁজিবাদীরা অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র- সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে থাকে। নিজের দেশে করে, বিদেশেও করে। তারা সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। দরিদ্র সৃষ্টি করে, আর গড়ে তোলে বৈষম্য। বৈষম্য দেখা দেয় ধনী ও দরিদ্রে, নারী ও পুরুষে, সবল ও দুর্বলে। যখনই কোনো বিপর্যয় ঘটে তখন এর আঘাতটা সবচেয়ে বেশি করে গিয়ে পড়ে দুর্বল মানুষজনের ওপর।

পুঁজিবাদ এখন যেমন উলঙ্গ তেমনি বেপরোয়া। এখন সে পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট আকার নিয়েছে। লজ্জা ভয় হায়াজ্ঞান সব খুইয়েছে, যা ইচ্ছা তাই করছে এবং করবে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন সে বিপজ্জনক। মুনাফা ছাড়া কিছু চেনে না। পুঁজিওয়ালাদের ভাবটা এখন এই রকমের যে বিশ্বায়নের দিন শেষ। বিশ্বায়নের নয়, দিন শেষ আসলে পুঁজিবাদেরই।

পুঁজিবাদীরা যুদ্ধ লাগায়। মারণাস্ত্রের আঘাতে মানুষ মারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলছে, লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে দিয়েছে। অতীতের দুটি বড় বিশ্বযুদ্ধ তাদেরই কীর্তি। এখন প্রতিনিয়ত স্থানীয় যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে, বিবদমান উভয় পক্ষের কাছে নগদ অর্থে অস্ত্র বিক্রি করছে। এও তাদের হস্তক্ষেপের আরেক নৃশংস দৃষ্টান্ত বটে। উস্কানি দিয়ে থামেনি, ইউক্রেনকে মাঝখানে রেখে পুঁজিবাদী দুই পক্ষ যুদ্ধ বাঁধিয়েছে।

পুঁজিবাদীরা অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র-সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে থাকে। নিজের দেশে করে, বিদেশেও করে। তারা সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। দারিদ্র্য সৃষ্টি করে আর গড়ে তোলে বৈষম্য। বৈষম্য দেখা দেয় ধনী ও দরিদ্রে, নারী ও পুরুষে, সবল ও দুর্বলে। যখনই কোনো বিপর্যয় ঘটে তখন এর আঘাতটা সবচেয়ে বেশি করে গিয়ে পড়ে দুর্বল মানুষজনের ওপর।

সারাবিশ্বেই এখন পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। এর কাছে দুষ্কর্মের জবাব চাইবে এমন কোনো রাষ্ট্রশক্তি এখন আর অবশিষ্ট নেই। সে এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক বিস্তৃত, প্রবল ও স্বৈরাচারী। ভেতরে-বাইরে সে যে স্বৈরাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে জবাবদিহির প্রশ্ন উঠছে না। ব্যাপারটি কেমন তা বোঝা যায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের চালিয়ে যাওয়া নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা, ভূমি দখল ও উচ্ছেদ, নিপীড়নে। ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। এদিকে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুই মস্ত বড় প্রতিবেশী পুঁজিবাদী চীন ও পুঁজিবাদী ভারতÑ কেউই গা করছে না। কারণ উভয়েরই চোখ রয়েছে দেশটির তেল-গ্যাসের ওপর। রাশিয়াও দেখা যাচ্ছে লাভের লোভে মিয়ানমারের শাসকদের দিকে ঝুঁকছে।

মোট কথা, পুঁজিবাদের হস্তক্ষেপ আজ সর্বত্র। পুঁজিবাদের বিকল্প সামাজিক মালিকানা। বাঁচতে হলে সে পথেই যাওয়া চাই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
চীনের কাছে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ
‘প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অগ্রাধিকার পাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন’
রাজবাড়ীতে অস্ত্রসহ যুবক গ্রেপ্তার
মহম্মদপুরে অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর, আহত ২০
৬০৯ কোটি টাকার এলএনজি কিনছে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ককে কুপিয়ে জখম, সাবেক মেয়রসহ আহত ৭
শাহজালাল বিমানবন্দরে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সোনা জব্দ
যুক্তরাজ্যে নির্বাচন আগামীকাল, লড়াই করছেন ৩৪ বাংলাদেশি
কর্মবিরতিতে অচল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ওবায়দুল কাদের
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft