বুধবার ৩ জুলাই ২০২৪
সাহিত্য চর্চায় পুরস্কার; যোগ্য-অযোগ্য বিবাদ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪, ৩:১১ PM
আমাদের দেশে বড় ছোট যে পুরস্কারই হোক না কেন দেওয়া হলেই নানা মহল থেকে আওয়াজ ওঠে। মানে সমালোচনা শুরু হয়। প্রশ্নের সারমর্ম একটাই, যোগ্য মানুষকে দেওয়া হলো তো? আমরা সকলেই নিজেকে যোগ্য মনে করি। কিন্তু আমাদের দীনতা হলো নিজেকে ছাড়া প্রায় বাকি সবাইকেই অযোগ্য ভাবি! আর বড় কোনো পুরস্কার হলে তো কথাই নেই। ফেসবুকের পাতাগুলো ভরে যায় সমালোচনায়। এটা ঠিক যে অযোগ্য মানুষের হাতেও পুরস্কার উঠছে। তাই বলে ঢালাও তো নয়। তাছাড়া অযোগ্য লোক কোথায় বসে নেই? খেয়াল করে দেখুন আপনার আমার মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে কত অযোগ্য মানুষ! তাহলে এক্ষেত্রে বাদ যাবে কেন? প্রশ্ন হলো একজন লেখকের কাছে সত্যি কি পুরস্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? পুরস্কার বা ইংরেজি রিওয়ার্ড শব্দটি প্রতিটি কর্মে নিয়োজিত মানুষের জন্যেই অতি কাক্সিক্ষত একটি সময় যা হতে পারে বস্তুগত বা অবস্তুগত।

পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পুরস্কার বলতে ব্যক্তি বা দলগত পর্যায়ে সাফল্যের স্বীকৃতি কিংবা কর্মদক্ষতার উজ্জ্বল নিদর্শনের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত পদক বা সম্মাননাকে বুঝায়। বস্তুগত পুরস্কার হলো অর্থ বা বাড়ি-গাড়ি উপহার বা অন্য কোনো মূল্যবান বস্তু এবং অবস্তুগত পুরস্কার হলো সম্মান, পদোন্নতি, প্রশংসা, স্বীকৃতি এমনকি ছোট্ট একটি ধন্যবাদ পর্যন্তও হতে পারে। অফিসে কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ পদোন্নতি আবার শাস্তিস্বরুপ পদাবনতিও দেওয়া হয়। পুরস্কারের ফলে কর্মীদের মধ্যে কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। পুরস্কার যেকোনো ভাবেই হোক না কেন তা মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে কারণ স্বাভাবিকভাবে কাজের স্বীকৃতি পেলে মানুষ আনন্দিত হয়। এই পুরস্কার আরো কাজে উদ্বুত্ত করে। আর না পেলে মন খারাপ হয়। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই যে পুরস্কার অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে বিষয়টা এমন নয়। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয় যদি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও মূল্যায়ন না হয়। পৃথিবীতে আজ কর্মের পরিধি এবং বৈচিত্র্যময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সাথে বেড়েছে পুরস্কারের সংখ্যা। কে পাচ্ছে এবং কেন পাচ্ছে তা যেন মাঝে মধ্যেই অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে। ফলে পুরস্কার নিয়ে আগের মতো উৎসাহ দেখা যায় না। পুরস্কার নিয়ে হয় বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে আজ পুরস্কার শব্দটি বেশি সমালোচিত। এর দোষ পুরস্কারের নয় যারা পুরস্কার দেয় তার। কার পাওয়া উচিত এবং কেন পাওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা হয়। সবার দৃষ্টিভঙ্গি যে সমান হবে তা নয় তবে পক্ষপাতিত্বমূলকভাবে কাউকে বঞ্চিত করে কাউকে প্রদান করা হলে তা নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হবেই। আবার টাকা-পয়সা থাকলে দু-একটা সম্মাননা জুটে যায়- এ কথাও প্রচলিত। তবে একটা বিষয় সত্যি যে আজ পুরস্কার নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমছে।

পুরস্কারকে যারা ব্যবসার মানদণ্ডে নামিয়ে এনেছে তাদের জন্য মেধার মূল্যায়নের এই দুর্দশা। আরে ভাই সত্যি কথা হলো মোটা অঙ্কের ডোনেশন মানে টাকা দিলেই পুরস্কার মেলে। এটা সহজে কেউ স্বীকার করলে ভালো আর না করলে কোনো কথা নাই। তবে এ কথা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোনো ধরনের পুরস্কার সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে কাম্য তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে পুরস্কার যে কাক্সিক্ষত তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কারণ পুরস্কার শব্দটি মানুষের কাজের স্বীকৃতি এবং দক্ষতার মূল্যায়নের সাথে সম্পৃক্ত। তবে এমন মানুষও আছেন যারা পুরস্কারের জন্য কাজ করেন না। এইসব মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। হাতে গোনা। তারা কাজ করেন নিরবে, নিভৃতে। এইসব মানুষের কাজের উদ্দেশ্য পুরস্কার নয়। অনেকের কথাই আমাদের জানা হয় না। কারণ ঘটা করে পুরস্কার নিয়ে এরা সামনে আসেন না। এই নিভৃতচারী পরোপকারী মানুষের খোঁজ পাই পত্রপত্রিকার মাধ্যমে, মাঝেমধ্যে। তাদের জীবন এবং প্রাপ্ত সবকিছুই তারা মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেন। এর বিপরীত শ্রেণির মানুষও আছে যারা পুরস্কারের জন্যই কাজ করেন! অর্থাৎ কোনোভাবে একটি পুরস্কার পাওয়া এবং তা সর্বস্তরে ব্যবহার করাই জীবনের মূলমন্ত্র! আর টাকা পয়সার জোরে আজকাল পুরস্কার মিলতে কোনো সমস্যা হয় না। আবার পুরস্কার নিয়ে বাণিজ্যও হচ্ছে। পুরস্কার দেওয়ার জন্যই অনেক ভঁউফোড় মানুষ সংগঠনের জন্ম দিচ্ছে। একটু চোখ রাখলেই সেসব পুরস্কারের খোঁজ মেলে। অর্থের বিনিময়ে পুরস্কার বাগিয়েও নেওয়া যায়। সাধারণত বিজয়ীকে মৌখিক অভিনন্দন জানানোর সাথে সাথে কোনো বস্তুগত পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বিশে^ বহু প্রাচীনকাল থেকেই পুরস্কারের প্রচলন রয়েছে। নামি-দামি সেসব পুরস্কার পাওয়া নিয়ে হৈ-চৈ হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো নোবেল পুরস্কার। পৃথিবীতে এটিকে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামানুসারে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন। সেই উৎস থেকেই ছয়টি ক্ষেত্র পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি শাখায় এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আর একটি পুরস্কার হলো অস্কার বা একাডেমি পুরস্কার। পুরস্কারটি হচ্ছে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সে বা এএমপিএএস কর্তৃক প্রদত্ত বার্ষিক পুরস্কার যা চলচ্চিত্রাঙ্গনের সাথে জড়িত পরিচালক, অভিনেতা এবং লেখকদের প্রয়াসে গড়া সেরা ছবিসহ সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়। প্রতিবছরই এসব পুরস্কার প্রদান করা হয়। সবাই যে পুরস্কার গ্রহণ করেছেন এমনটাও কিন্তু নয়। কেউ কেউ পুরস্কার পেয়েও নানা কারণে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আবার বর্জনও করেছেন। এর মধ্যে একজন হলেন আমাদের বিশ^কবি যিনি ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনিই আবার নাইটহুড বা স্যার পদবি বর্জন করেছিলেন ব্রিটিশদের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ। নাইটহুড উপাধি অত্যন্ত সম্মানজনক তবু তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন। এ রকম উদাহরণ আরো রয়েছে। ১৯৭০ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অব প্রাইড অব পারফরমেন্স ফর পেইন্টিং পদক প্রত্যাখান করেন।  জীবিত থাকাকালীন মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে ভারতরত্ন পুরস্কার প্রদানের কথা ঘোষণা করা হলেও ‘পুরস্কার নির্বাচক সমিতির কাউকে এ পুরস্কার দেওয়া উচিত নয়’ এ কারণে তিনি বিনম্র শ্রদ্ধায় উক্ত পুরস্কার প্রত্যাখান করেন। পরে অবশ্য ১৯৯২ সালে তাকে মরণোত্তর ভারতরত্ন পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়টি এমন না যে পুরস্কার পেলেই তার কাজ মূল্যবান  অন্যথায় তার কোনো মূল্য নেই। অনেকেই নামের আগে-পরে যে হারে ডিগ্রি যোগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন একইভাবে পুরস্কারের তালিকাও যোগ করেন।

আজকাল আবার ডিজিটাল সম্মাননা পত্র দেওয়া হয়। অবশ্য সব কিছুর ডিজিটালের যুগে এটাও বাদ যাবে কেন? ছবিসহ এ ধরনের সম্মাননা দেওয়ার রীতি আজকাল বেশ প্রচলিত। এত এত সম্মাননা কে দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে বা কেনই বা দিচ্ছে আবার এতসব সম্মাননার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা তাও কারো জানা নেই। যারা সম্মাননা পাচ্ছেন তারা পরবর্তীতে তার কাছ থেকে আর কতটুকু কাজ পাচ্ছেন তা নিয়েও আর কেউ খোঁজ রাখছে না। যদি সেই সম্মাননার মর্যাদা ধরেই না রাখা যায় তবে তার স্বার্থকতা কোথায়? পুরস্কার মানুষের কাজের যোগ্য স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত এবং তা যোগ্য মানুষকেই প্রদান করা উচিত। ব্যবসায়কি মানদণ্ড থেকে বের করে প্রকৃত গুণীর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা যা কোনো একটি, দুটি পুরস্কার গ্রহণে জীবনে পূর্ণতা আনে না। কেউ যদি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবেই তার জীবন হবে স্বার্থক, গৌরবমণ্ডিত।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
৬০৯ কোটি টাকার এলএনজি কিনছে সরকার
তিস্তা চুক্তি হবে আন্তর্জাতিক নদী আইন মেনে: নজরুল
তাসকিন বললেন, ‘বেশিরভাগ সংবাদ এবং তথ্য গুজব’
ইসরায়েলের নতুন আদেশ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
নির্বাচন কমিশনের মামলায় খালাস পেলেন ইমরান খান
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা, সিলেটসহ পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ককে কুপিয়ে জখম, সাবেক মেয়রসহ আহত ৭
শাহজালাল বিমানবন্দরে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সোনা জব্দ
যুক্তরাজ্যে নির্বাচন আগামীকাল, লড়াই করছেন ৩৪ বাংলাদেশি
কর্মবিরতিতে অচল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft